বিদ্যুৎ নেই,২৪ বছর ধরে ইলেকট্রিশিয়ান


প্রকাশের সময় :২২ অক্টোবর, ২০১৭ ১:২১ : পূর্বাহ্ণ 707 Views

সিএইচটি টাইমস নিউজ ডেস্কঃ-বান্দরবানের থানচি উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ে ২৪ বছর ধরে ইলেকট্রিশিয়ান পদে চাকরি করছেন রোকন মিয়া।অথচ এ উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করা হয় চলতি বছরের এপ্রিলে।বিদ্যুৎহীন এলাকায় ইলেকট্রিশিয়ান পদে কী কাজ করছেন,তা এত দিন খতিয়ে দেখেনি নিরীক্ষা বিভাগসহ সরকারের কোনো পক্ষ।তাঁকে নিয়ে কালের কণ্ঠ অনুসন্ধান শুরু করার পর তিনি স্বেচ্ছাবসরের দরখাস্ত করেছেন।

কে এই ব্যক্তি???
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার সুরাটি গ্রামের বাসিন্দা সিরাজুল হকের ছেলে রোকন মিয়া থানচিতে আসেন ১৯৮১ সালের মার্চে।পল্লীপূর্ত কর্মসূচির আওতায় উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ে পিয়ন পদে তিনি যোগ দেন ১৯৮১ সালের ৩০ মার্চ।এখানে কোনো কর্মকর্তা থাকেন না।কাজও নেই।এরই মধ্যে ১৯৯৩ সালের ১ আগস্ট প্রকল্পভুক্ত অস্থায়ী এ কর্মচারীকে বিদ্যুৎহীন উপজেলায় ইলেকট্রিশিয়ান পদে চলতি দায়িত্ব দেখিয়ে চাকরি স্থায়ী করা হয়।

আলাদিনের চেরাগ না,ঠিকাদারি???
কর্মহীন পদে চাকরি করায় তিনি ঠিকাদারিতে জড়িয়ে পড়েন।উপজেলা পরিষদ,উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় এবং বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী,১৯৮১ সাল থেকে এ পর্যন্ত চার শতাধিক প্রকল্পের ঠিকাদার ছিলেন রোকন।কিন্তু থানচি উপজেলা প্রকৌশলীর দপ্তরের কাগজপত্রে তার প্রমাণ নেই।প্রকল্পগুলোর ঠিকাদার হিসেবে ‘ইউ টি মং কন্সট্রাকশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ রয়েছে।কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানকালে কোনো কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান তাঁদের নামে কাজ করা বাবদ রোকনের কাছ থেকে টাকার ভাগ পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার জানান, দরপত্র দাখিল,কার্যাদেশ ও বিলে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম থাকলেও তাঁদের কাছ থেকে অনুমতি বা স্বাক্ষর নেওয়া হয়নি। প্রকৌশলীর কার্যালয়ের সহায়তায় রোকন এসব ক্ষেত্রে জাল সিলমোহর ও স্বাক্ষর দিয়ে সরকারি কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন।তাঁরা কোনো টাকা পাননি।বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী,১৯৯৭ সালে জ্ঞানলাল পাড়ায় ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ,১৯৯৮ সালে সেগুম ঝিড়িতে ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ (বর্তমানে অস্তিত্ব নেই),একই বছরে থানচি উপজেলা কর্মচারী ক্লাব নির্মাণ,১৯৯৯ সালে রেমাক্রী বাজারে পাকা সিঁড়ি নির্মাণ,২০০০ সালে বলিপাড়া জুনিয়র হাই স্কুল ভবন সংস্কার,২০০১-০২ অর্থবছরে ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ইউএনও কার্যালয় (দোতলা) ভবন নির্মাণ,২০০৩-০৪ অর্থবছরে ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে বলিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স নির্মাণ,২০০৯-১০ সালে ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে রেমাক্রী ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স নির্মাণ,একই অর্থবছরে ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে রেমাক্রী বাজার হয়ে পনেডং পাড়া যাওয়ার রাস্তায় মরা ঝিড়িতে পিআইও সেতু (কালভার্ট) নির্মাণ,২৭ লাখ টাকা ব্যয়ে থানচি হেডম্যান পাড়া মগক ঝিড়িতে পিআইও সেতু নির্মাণ,২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে ডরমেটরি সংস্কার করেছেন রোকন।২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে রেমাক্রী বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ,১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে জনসেবা কেন্দ্র (গোলঘর) নির্মাণ,৩৮ লাখ টাকা ব্যয়ে পর্দ্দমুখে পিআইও সেতু নির্মাণ,৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে পিডিইপি-২-এর আওতায় হালিরাম পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ,২০১৬-১৭ অর্থবছরে পিডিইপি-৩ কর্মসূচির আওতায় ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ক্যচুপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ,৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে তিন্দু গ্রোপিং পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ,২০১৭-১৮ অর্থবছরে আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে সাঙ্গু সেতুর নিচে দোতলা ডরমেটরি ভবন নির্মাণ কাজ চলমান।

কাজের মান নিম্নঃ-স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করে, বলিপাড়া ইউনিয়নের ক্যচুপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবন নির্মাণ কাজে পরিত্যক্ত ইটের কংক্রিট ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে।বড় মদক বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবক সদস্য উবামং মারমা জানান,বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবনের নির্মাণকাজের জন্য অবৈধ ভাটা স্থাপন করা হয়েছে। লাকড়ির আগুনে পুড়ে তৈরি করা নিম্নমানের ইট, স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত কাদা ও আবর্জনাযুক্ত বালু ব্যবহার করা হচ্ছে।তাঁরা নিম্নমানের কাজে বাধা দেওয়া সত্ত্বেও ঠিকাদার রোকন গায়ের জোরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

নতুন অভিযোগঃ-সম্প্রতি ইউএনও বরাবর থানচি বাজারের ব্যবসায়ী শামসুল ইসলাম একটি অভিযোগ করেন।এতে উল্লেখ করা হয়েছে,২০০৯ সালে শাহজাহানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ তিনটি প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ করেন রোকন।এসব কাজে অংশীদার হিসেবে শামসুলের কাছ থেকে রোকন কয়েক দফায় ১৩ লাখ টাকা নিয়েছেন।ব্যবসায়ীর ডায়েরিতে স্বাক্ষর দিয়ে টাকা নেওয়ার প্রমাণ রয়েছে।টাকা না পেয়ে ব্যবসায়ী প্রশাসনের কাছে আবেদন করেন।ইউএনও লিখিতভাবে পাওনা টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য রোকনকে নির্দেশ দেন।

স্বেচ্ছায় অবসরের আবেদনঃ-২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি চেয়ে গত ৮ আগস্ট আবেদন করেছেন রোকন।এর জের ধরে কর্মকর্তারা দাবি করেন, তিনি অবসরে চলে গেছেন।তবে গত ১০ অক্টোবর হাজিরা খাতা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে,প্রথম আট দিনের ঘরে তাঁর স্বাক্ষর রয়েছে।খোলা থাকলেও অন্য দুই দিনের ঘর ফাঁকা।একজন কর্মচারী জানান,৩ অক্টোবর বেতন নিতে এসে তিনি সেপ্টেম্বরের সব দিনের স্বাক্ষরের পাশাপাশি অক্টোবরের আট দিনের স্বাক্ষর করেছেন।পরের মাসে এসে বাকি স্বাক্ষরগুলো করবেন।সংবাদ সংগ্রহের জন্য গত তিন মাসে এ প্রতিবেদক অন্তত ১০ বার থানচি সফর করেছেন।একবারও রোকনের সাক্ষাৎ পাননি। একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল করলেও সংযোগ পাননি।ফলে এসব অভিযোগের বিষয়ে তাঁর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্যঃ-এসব বিষয়ে থানচি উপজেলার প্রকৌশলী তোফাজ্জল হোসেন ভূঞা বলেন, ‘আমার কার্যালয়ের প্রায় সব পদ শূন্য।যাঁরা আছেন তাঁরা নিয়মিত থাকেন না।এ অবস্থায় প্রকল্প এলাকা সামলাতে রোকনের ওপর নির্ভর করা ছাড়া আমার উপায় কী?এ কারণে সরকারি কর্মচারী হয়ে ঠিকাদারি করলেও বাধা দিতে পারি না।’ একজন সরকারি কর্মচারী হয়ে একই কার্যালয়ে ঠিকাদারির প্রমাণ পাওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন জানতে চাইলে থানচির ইউএনও মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম কোনো মন্তব্য করেননি।থানচি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য হ্লাচিং বলেন, ‘দুর্গম এলাকায় কেউ দরপত্র দিতে আসে না।তাই রোকন না থাকলে সব উন্নয়নকাজ থেমে যাবে।’(((মনু ইসলাম, বান্দরবান;কালেরকন্ঠ)

ট্যাগ :

আরো সংবাদ

ফেইসবুকে আমরা



আর্কাইভ
November 2024
M T W T F S S
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  
আলোচিত খবর

error: কি ব্যাপার মামা !!