উত্তরা, মিরপুর, পল্লবী, ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, শাহবাগ, প্রেসক্লাব হয়ে মতিঝিল। রাজধানীর এই রাস্তাগুলো ধরে মাটি ফুঁড়ে সাপের মতো একেবেকে তৈরি হচ্ছে উড়াল সড়ক। অফিসিয়াল নাম মেট্রোরেল। উত্তরা বা মিরপুর থেকে মতিঝিলে কোনো কাজে আসতে যাদের দিনের বেশিরভাগ সময় খরচ করতে হয় তারা মেট্রোরেলে সেই একই পথ আসবেন মাত্র কয়েক মিনিটে।
এতো গেল শুধু একটা রুটের চিত্র। এরকম আরো ৫টি মেট্রোরেল রুট নির্মাণ করা হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। তখন মোট ৬টি রুট মিলে রাজধানীতে উড়াল সড়কের দৈর্ঘ্য হবে ১২৯ কিলোমিটার। সবগুলো রুটে স্টেশন থাকবে ১০৪টি। ৫৩টি মাটির নিচে আর ৫১টি স্টেশন থাকবে ওপরে। মিনিটের ব্যবধানে যাতায়াত করতে থাকবে একের পর এক হাইস্পিড ট্রেন। একদিনে ৬টি রুটে চলাচল করতে পারবেন ৫০ লাখ যাত্রী।
প্রথম মেট্রোরেল রুট ৬ এখন দৃশ্যমান। খুঁটির ওপর পাত দিয়ে এরইমধ্যে লাইন বসানো হয়েছে প্রায় ৩ কিলোমিটার। আগামী বছরের ডিসেম্বরে থেকে পুরোদমে শুরু হবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত যাত্রী চলাচল। বলা হচ্ছে, দ্রুত গতির এই ট্রেনে ঘন্টায় ৬০ হাজার যাত্রী উভয়দিক থেকে যাওয়া আসা করতে পারবে।
এদিকে, চলতি বছর বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত আরেক পাতাল মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ শুরু হচ্ছে। যা শেষ হবে ২০২৬ সালে। এছাড়া হেমায়েতপুর থেকে নতুন বাজার এবং হেমায়েতপুর থেকে রামপুরা হয়ে দাশেরকান্দি আরও ২টি রুট নির্মাণ শেষ হবে ২০২৮ ও ২০৩০ সালে।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ম্যানেজিং ডিরেক্টর এম এ এন ছিদ্দিক জানান, পুরো ঢাকা জুড়ে তখন হবে প্রায় ১২৯ কিলোমিটার মেট্রোরেল। এই মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক হবে অনেকটা মাকরসার জালের মত। এর মধ্যে সড়কের উপর দিয়ে প্রায় ৬৭ কিলোমিটার আর মাটির নিচ দিয়ে হবে ৬১ কিলোমিটার মেট্রোরেল।
ডিএমটিসিএল জানায়, প্রথম মেট্রোরেল এমআরটি লাইন ১ উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত সাড়ে ২১ কিলোমিটার হবে। এতে মোট ১৭টি স্টেশন থাকবে। প্রথম পরিকল্পনায় একটি উত্তরা থেকে মতিঝিল ছিল। এখন প্রায় ১ কিলোমিটার বাড়িয়ে মেট্রোস্টেশন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে এবং সেখানে হচ্ছে শেষ স্টেশন।
ডিএমটিসিএল এমডি জানান, মতিঝিল থেকে কমলাপুর যেতে ৩টি দিকে যাওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এর মধ্যে তৃতীয় সম্ভাব্যতা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশ দিয়ে যে গলি এখন আছে সেটি। এ পথে দূরত্ব একটু বেশি হলেও তুলনামূলক ভবন ভাঙ্গা পড়বে কম। ৩১ টি ভবন ভেঙ্গে ফেললে ট্রেন রুট কমলাপুর পর্যন্ত চলে যাবে। এছাড়া এ পথে রেলওয়ে ও বিআরটিসিকে জায়গা ছাড়তে হবে।
ছিদ্দিক জানান, এখন স্যোশাল সার্ভে চলছে। সাধারণ মানুষকে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার জন্য বোঝানো হচ্ছে। তারাও রাজি হচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে সরকারি দামে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার নির্দেশনাও দিয়েছেন। আর স্টেশনটি কমলাপুরের কোথায় হবে সেটি এখনও ঠিক হয়নি। এ নিয়ে শিগগিরই রেল মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে বসবে ডিএমটিসিএল।
দ্বিতীয় মেট্রোরেল রুট এমআরটি লাইন ৫ বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত যাবে। যার পুরোটাই হবে পাতাল। এ রুটের সঙ্গে কুড়িল থেকে ৩০০ ফিট দিয়ে নারায়নগঞ্জের রুপগঞ্জের পিতলগঞ্জ পর্যন্ত সড়কের উপর দিয়ে হবে মেট্রোরেল।
ছিদ্দিক জানান, ডিসেম্বরে পিতলগঞ্জে ওই লাইনের ডিপো নির্মাণ শুরুর মধ্য দিয়ে কাজ শুরু হবে। টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) দিয়ে বিমানবন্দর থেকে বাড্ডা হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত খনন চলতে থাকবে। দিনে ১০ মিটার করে খনন চলবে। খননের সঙ্গে রেলট্রাকও বসিয়ে দেওয়া থাকবে। এতে যান চলাচলে সমস্যা হবে না। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত পুরো ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড। এতে পাতাল স্টেশন থাকবে ১২টি। মাটির থেকে ১০ মিটার নিচে হবে স্টেশন। সবচেয়ে গভীরতায় যাবে মালিবাগ অংশ। সেখানে প্রায় ৩৭ মিটার নিচে দুইতলা আন্ডাগ্রাউন্ড স্টেশন হবে। আর পূর্বাচলের দিকে মেট্রোরুট যাবে আরও ১১ দশমিক ৩৬৯ কিলোমিটার।
তৃতীয় যে মেট্রোরেল এমআরটি লাইন ৫ নামে পরিচিত সেটি হবে দুই রুটের। একটি রুট হেমায়তপুর থেকে নতুন বাজার ও অন্যটি হেমায়েতপুর থেকে আফতাবনগর দাশেরকান্দি পর্যন্ত। প্রথম রুটের সাড়ে ১৩ কিলোমিটার পাতাল রেলে ৯টি স্টেশন এবং সাড়ে ৬ কিলোমিটার উড়াল রুটে থাকবে ৫টি স্টেশন।এমআরটি লাইন ২ নামে পরিচিত চতুর্থ মেট্রোরেল লাইন যাবে গাবতলী থেকে চট্টগ্রাম রুটে। উড়াল এবং পাতাল মিলিয়ে এই রুটটি হবে ২৪ কিলোমিটারের।
পঞ্চম মেট্রোরেল রোড এমআরটি লাইন ৪ হবে কমলাপুর থেকে নারায়গঞ্জ পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার। বিদ্যমান রেললাইনের পাশ দিয়ে তৈরি হবে উড়াল সড়কটি।
এমআরটি লাইন ৩ নামে যে প্রকল্প সেটি গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্মাণ হবে। এটিকে বলা হচ্ছে মেট্রোরেল বিআরটি। এর নির্মাণ এখন চলছে।
মেট্রোরেল নিয়ে সরকারের এই পরিকল্পনার সঙ্গে খানিকটা দ্বিমত জানান বুয়েটের অধ্যাপক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ শামসুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৬টি মেট্রোরুট একসঙ্গে চালু হওয়ার পর তা মোট গণপরিবহণ চাহিদার মাত্র ১৭ শতাংশ মেটাবে। অথচ ৪০ শতাংশ চাহিদা মেটায় সাধারণ বাস। তাই বাস রুট ফ্রাঞ্চাইজ করে সুশৃংখল করতে না পারলে শুধু মেট্রোরুট করলে যানজট নিরসনে তেমন কোনো উপকার আসবে না।