জাতিসংঘ আগামী ৫০ বছরের মধ্যে ‘রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার’ বিলুপ্ত হওয়ার সতর্ক বার্তা দিলেও বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে। গত তিন বছরে বেড়েছে ৮টি। সর্বশেষ ২০১৫ সালের বাঘশুমারিতে ১০৬টি বাঘ থাকার কথা বলা হয়েছিল। বর্তমানে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৪টি।
বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে বেঙ্গল টাইগার কনজারভেশন একটিভিটি (বাঘ) মোট চারটি ধাপে তিনটি ব্লকে ১ হাজার ৬ শত ৫৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ক্যামেরা বসিয়ে ২ শত ৪৯ দিন ধরে পরিচালিত জরিপে ৬৩টি পূর্ণ বয়স্ক বাঘ, ৪টি জুভেনাইল বাঘ (১২-১৪ মাস বয়সী) এবং ৫টি বাঘের বাচ্চার (০-১২ মাস বয়সী) ২৪৬৬টি ছবি পেয়েছে। বাঘ গণনার কার্যক্রম (দ্বিতীয় পর্যায়) শেষে এই তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ বন বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট একজন বন কর্মকর্তা জানান, সুন্দরবনকে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা এই তিন অংশে ভাগ করে যেসব এলাকায় বাঘ চলাচল বেশি সেখানে বাঘ জরিপ পরিচালনা করা হয়। সাতক্ষীরা অংশে জরিপ করা হয় ২০১৬ সালে। অতঃপর গত বছর খুলনা ও বাগেরহাট অংশে জরিপ চালানো হয়। অতীতের প্রায় সবগুলো জরিপই করা হয়েছিল পাগমার্ক (পায়ের ছাপ) পদ্ধতিতে। এবারই প্রথম ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘের অস্তিত্ব চিহ্নিত হয়েছে। সে হিসেবে তিন বছরের ব্যবধানে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে ৮ শতাংশ।
জানা যায়, বন অধিদপ্তরের সঙ্গে চলতি বাঘ শুমারিতে অংশ গ্রহণ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসনিয়ান কনজারভেশন ইন্সটিটিউটের ওয়াইল্ড টিম। আর গবেষণায় তথ্য বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ। ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ গণনার এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১১৪ কোটি টাকা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বাঘ বিশেষজ্ঞ ড. মনিরুল এইচ খান জানান, বাঘের সংখ্যা কমে যায়নি এটাই সুখবর। ২০১৫ সালে বাঘের সংখ্যা যে ১০৬টিই ছিল তা নয়, কম-বেশিও হতে পারে। আবার এখন ১১৪টি আছে, তার মানে ১১৪টিই এমন নয়। বেশিও হতে পারে। তবে বাঘ শুমারিতে ‘ক্যামেরা ফাঁদ’ বা ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে উঠে আসা এ সংখ্যাটি মোটামুটি বাস্তব সংখ্যার কাছাকাছি। বনবিভাগের একজন জরিপ কর্মকর্তা জানান, সুন্দরবনে যে অঞ্চলগুলোতে বাঘের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি সেই এলাকাগুলোতে জরিপ চালানো হয়েছে। ফলে প্রকৃত সংখ্যাটা পাওয়া গেছে।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩৫টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে স্বাভাবিকভাবে মারা গেছে মাত্র ১০টি। বাকি ২৫টির মধ্যে ১৪টি বাঘ পিটিয়ে মেরেছেন স্থানীয় জনতা, ১০টি নিহত হয়েছে শিকারিদের হাতে এবং একটি নিহত হয়েছে ২০০৭ সালের সিডরে। প্রসঙ্গত যে, চলতি মাসের শুরুর দিকে জাতিসংঘের নতুন এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। এ অবস্থায় হারিয়ে যেতে পারে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
২০৭০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বাঘের জন্য কোনো উপযুক্ত জায়গা থাকবে না। কেননা, বিশ্বের তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধিসহ উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এই বনে টিকে থাকা কয়েক শত বাঘ বিলীন হওয়ার জন্য যথেষ্ট। বাংলাদেশ ও ভারতের চার হাজার বর্গমাইল এলাকা নিয়ে সুন্দরবন। সুন্দরবনে এই প্রাণীর আবাসস্থল এখন চরম হুমকির মুখে।
এদিকে আরো বলা হয়, সুন্দরবনই হচ্ছে এশিয়ার মধ্যে বন্য প্রাণীর বৃহত্তম আবাসভূমি। বর্তমানে সুন্দরবনে ৩৭৫ প্রজাতির বন্য প্রাণী রয়েছে। বন বিভাগের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সুন্দরবন অঞ্চলে ৪৪টি বাঘ হত্যার ঘটনা ঘটে।
১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত দুই দফায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করেন বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিলের ট্রাস্টি ব্রিটিশ পাখিবিদ গাই মাউন্টফোর্ট। সে সময় বন বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো তাকে হয়, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৩০০টি।
তবে সুন্দরবনে প্রথমবারের মতো বাঘ শুমারি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালে। একটি বেসরকারি গবেষণায় জার্মান গবেষক হেন রিডসে জানান সুন্দরবনে ৩৫০টি বাঘ রয়েছে। ১৯৮২-৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ পরিচালিত এক জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৩০০টি বলে উল্লেখ করা হয়। ১৯৯৮ সালে নেপালি বংশোদ্ভূত আমেরিকান গবেষক কীর্তি তামাং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নিয়ে পরিচালিত একটি প্রকল্প শেষে বাঘের সংখ্যা ৩৫০টি বলে উল্লেখ করেন।
পরবর্তীতে ২০০৪ সালে একটি জরিপ শেষে বন বিভাগ জানায়, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০টি। কিন্তু এই জরিপটিতে তাড়াহুড়ো, ও কাঁচা হাতে তথ্য সংগ্রহের অভিযোগ ওঠে। ২০০৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বাঘ গবেষক ড. মনিরুল এইচ খান ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে গবেষণা করে জানান, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ২০০টি।
এরপর ২০১০ সালে বন বিভাগ এবং ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ যৌথভাবে পরিচালিত বাঘ শুমারির পর জানায়, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪০০ থেকে ৪৫০টি। পাঁচ বছর পর ২০১৫ সালে বন বিভাগ অপর একটি জরিপ শেষে ঘোষণা দেয়, সুন্দরবনে বাঘ রয়েছে ১০৬টি। তবে ২০১৫ সালের জরিপটিতে অত্যাধুনিক ক্যামেরা ট্রাপিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হলেও আগের প্রায় সবগুলো জরিপই করা হয়েছিল পাগমার্ক (পায়ের ছাপ) পদ্ধতিতে।