রাজধানীর উত্তরায় বেসরকারি একটি ফার্ম হাউজে চাকরি করেন মো. সাইফুল ইসলাম। শুক্রবার বাদে সপ্তাহে ছয় দিন তিনি পুরান ঢাকার ঢাকেশ্বরী এলাকা থেকে উত্তরায় যেয়ে অফিস করেন। সাইফুল জানান, অফিস টাইম ৯টায় শুরু হওয়ার কারণে তার প্রতিদিন সকাল সাতটার মধ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে হয়। ঢাকার অস্বাভাবিক যানজটের কারণে তার কম করে হলেও তার অন্তত পক্ষে দুই ঘণ্টা সময় লাগে অফিস পৌঁছাতে। কখনো আবার সাতটায় বের হয়েও দুই ঘণ্টায় অফিসে যাওয়া যায় না যানজটের কারণে। এতে করে প্রায়ই তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নিকট থেকে কথা শুনতে হয়।
তবে বছরখানেক আগে থেকে শুরু হওয়া মেট্রোরেলের কাজ নির্মাণ হওয়ায় তিনি দ্রুত অফিস যাওয়ার ব্যাপারে বেশ আশাবাদী। মেট্রোরেলের ব্যাপারে তিনি জানান, যে রুট দিয়ে মেট্রোরেল হচ্ছে তা আমার অফিস আর বাসার পাশ দিয়েই হচ্ছে। মেট্রোরেল হওয়ার পর আর সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই অফিস যেতে হবে না। অন্তত সকাল আটটায় বের হয়েও কোনো ধরণের যানজট ছাড়াই দ্রুত অফিস পৌঁছাতে পারবো।
সাইফুলের মতো অনেকেই আছেন যারা উত্তরা থেকে ফার্মগেট কিংবা মতিঝিল গিয়ে কাজ করেন। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন তারাই। মেট্রোরেল নির্মাণে আরো বেশি যানজটের ব্যাপারে জানতে চাইলে অনেকেই জানান, একটি ভালো কাজের জন্য যদি যানজট সহ্য করতে হয় তাহলে যানজটই ভালো। ভালো কিছু পেতে হলে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। এটাও না হয় মেনে নিলাম।
এদিকে, ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে স্বপ্নের মেট্রোরেল। উত্তরা দিয়াবাড়ির পর মিরপুর, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁওয়ে দৃশ্যমান হলো ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট বা মেট্রোরেলের কাজ। পিলারের উপর দৃশ্যমান হয়েছে মেগা প্রকল্পের স্প্যান। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের উড়ালপথ এবং স্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে চলতি বছরের (২০১৯ সাল) ৩০ ডিসেম্বর।
উত্তরা থেকে আগারগাঁও এলাকা পর্যন্ত সারিবদ্ধভাবে দৃশ্যমান হয়েছে সুউচ্চ মেট্রোরেল পিলার। আর এসব পিলারের উপরে বসছে স্বপ্নের স্প্যান। এ স্প্যানের উপরে বসবে ব্যালাস্টলেস মেট্রোরেল ট্র্যাক। ট্র্যাকে থাকবেনা পাথর ও কাঠের স্লিপার। কংক্রিটের স্প্যানের উপরে বসবে মেট্রোরেল ট্র্যাক।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, আগারগাঁও থেকে শেওড়াপাড়া পর্যন্ত সমস্ত পিলার শতভাগ নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এসব পিলারের উপরে বসছে স্প্যান। স্প্যানগুলো উত্তরা দিয়াবাড়ি এলাকায় অবস্থিত মেট্রোরেল ডিপোতে নির্মিত। শেওড়াপাড়ায় ৮টি পিলারের উপরে বসেছে স্প্যান। এক পিলার থেকে অন্য পিলার পর্যন্ত মোট ১২টি ছোট ছোট স্প্যান স্লাইস ব্যবহার করা হচ্ছে। মেট্রো রেলের প্রতিটি পিলারের ব্যাস দুই মিটার, ভূগর্ভস্থ অংশের ভিত্তি তিন মিটার। অন্যদিকে মাটি থেকে পিলারের উচ্চতা ১৩ মিটার। একটি স্তম্ভ থেকে আরেকটির দূরত্ব ৩০ থেকে ৪০ মিটার। এক পিলার থেকে অন্য পিলারে বসছে স্প্যান।
মাথার উপরে মেট্রোরেল স্প্যান স্থাপনে স্থানীয়দের মধ্যে দেখা দিয়েছে স্বস্তি। দ্রুতই ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাওয়া আশা করছে তারা। মিরপুর শেওড়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা নাজমুল হাসান। বসবাস করেন শাপলা সরণিতে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই উত্তরায় অফিসের উদ্দেশে যাত্রা করতে হয় নাজমুলের। মেট্রোরেল নির্মাণের কারণে প্রতিদিন সকালে জটলার পাশাপাশি ধূলাবালি মেখে অফিসে যেতে হয় তাকে। তবে মেট্রোরেলের স্প্যান বসানো দেখে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন নাজমুল। নাজমুল জানান, এখন যানজটের যে অবস্থা মেট্রোরেল হওয়ার পর যানজটের যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটবে তা ভাবতেও অবাক লাগে। চাই যেন দ্রুত এই প্রকল্পের কাজ শেষ হোক।
নাজমুল আরো বলেন, সকালে শেওড়াপাড়া থেকে জ্যাম ঠেলে অফিসে যেতে হয়। তবে পিলার হয়ে যাওয়ার পর সেই ধুলাবালি কিছুটা কমেছে। এখন দেখে বোঝা যাচ্ছে মেট্রোরেল দ্রুত সময়েই হবে, আমাদের দুর্ভোগও কমবে।
কর্মকর্তার বলছেন, উত্তরা থেকে মিরপুর হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের মোট ১৬ টি স্টেশন থাকবে। মেট্রোরেল মূলত পল্লবী হয় রোকেয়া সরণি ধরে এগুবে। শাহবাগ, টিএসসি হয়ে চলে যাবে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত। এর মাঝে ঢাকার ব্যস্ত ফার্মগেটসহ মেট্রোরেল থামবে গুরুত্বপূর্ণ সব স্টেশনে।
মেট্রোরেলে ২৪ টি ট্রেন প্রতি ঘণ্টায় আপ ও ডাউন রুটে ৬০ হাজার যাত্রী আনা নেয়া করতে সক্ষম হবে বলে দাবি করছেন কর্মকর্তারা। সবকিছু ঠিকঠাক গেলে ২০১৯ সালের মধ্যে আগারগাও পর্যন্ত এর কাজ শেষ হবে বলে আজ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী (পূর্ত) আবদুল বাকি মিয়া বলেন, দ্রুত গতিতে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু দিন নয় রাতেও চলছে স্প্যান বসানোর কাজ। উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁওয়ের দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। এরমধ্যে প্রায় দুই কিলোমিটার সড়ক জুড়ে স্প্যান বসানো হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই আগারগাঁও থেকে পরিকল্পনা কমিশনের দ্বিতীয় গেট পর্যন্ত স্প্যান বসিয়ে ফেলবো।
মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য বিদ্যুৎ নেওয়া হবে জাতীয় গ্রিড থেকে। ঘণ্টায় দরকার হবে ১৩ দশমিক ৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর জন্য উত্তরা, পল্লবী, তালতলা, সোনারগাঁ ও বাংলা একাডেমি এলাকায় পাঁচটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র থাকবে।
ঢাকার যানজট নিরসন ও নগরবাসীর যাতায়াত আরামদায়ক, দ্রুততর ও নির্বিঘ্ন করতে ২০১২ সালে গৃহীত হয় মেট্রোরেল প্রকল্প। এ প্রকল্পের দৈর্ঘ্য হবে উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত, ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার। অর্থাৎ এ এলাকায় বসবাসকারী লাখো নগরবাসী মেট্রোরেল ব্যবহার করে গন্তব্যে যাতায়াত করতে পারবেন দ্রুত। এ প্রকল্পে ২৪ সেট ট্রেন চলাচল করবে। ঘণ্টায় ১শ কিলোমিটার বেগে ছুটবে যাত্রী নিয়ে। উভয়দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন বহনে সক্ষমতা থাকবে মেট্রোরেলের। প্রকল্পের মোট ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার মধ্যে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে জাইকা ঋণ দিচ্ছে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা
চলতি বছরেই খুলে যাবে প্যাকেজ-০৩ ও ০৪ । এর আওতায় উত্তরা নর্থ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও ৯টি স্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে। উভয় প্যাকেজের কাজ ২০১৭ সালের ১ আগস্ট শুরু হয়েছে। সংশোধিত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। ফলে চলতি বছরেই স্বপ্নের মেট্রোরেলে চড়বে ঢাকাবাসী।