বিএনপি থেকে মনোনীত প্রার্থীদের বেশির ভাগই নাম লিখিয়েছেন বাতিলের খাতায়। কারণ বিএনপির বেশির ভাগ বিএনপি নেতাকর্মী ঋণখেলাপি, ভুল তথ্য প্রদান, তথ্য গোপন, অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় করায় বাতিল করা হয়েছে ১৪৫ জনকে। বিএনপির এক ডজন প্রার্থীর কাছে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা রয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার মতো। যার পুরো অর্থই খেলাপী হওয়া সত্ত্বেও ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন করেছিলেন তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খেলাপী ঋণের দায়ে মনোনয়ন বাতিল হয় অনেকের।
বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী এম মোর্শেদ খান মনোনয়নপত্র নিয়েছিলেন চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসন থেকে। তার প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকমের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকে খেলাপী ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯২ সালে প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সিটিসেলের নামে বড় অংকের ব্যাংক ঋণ নেয়। প্রতিষ্ঠানটি বেসরকারী খাতের এবি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, কমার্স, ব্র্যাক ব্যাংক, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, দ্য সিটি, ইস্টার্ন, এক্সিম, আইপিডিসি, আইএফআইসি, ন্যাশনাল, ট্রাস্ট, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক থেকে এসব ঋণ নেয়। এই ঋণ পরিশোধের জন্য সিটিসেল, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় প্যাসিফিক গ্রুপ। সব শেষে কর্মী ছাঁটাইয়ের পর বিলোপ সাধন করা হয় প্রতিষ্ঠানটির।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন চট্টগ্রাম- ৪ আসন থেকে। খেলাপী ঋণ রয়েছে তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রাইজিং স্টিলের। প্রতিষ্ঠানটি এবি ব্যাংকসহ ২৭টি ব্যাংকে তার খেলাপী ঋণ থাকায় মনোনয়ন বাতিল করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ঋণখেলাপির পরিমাণ প্রায় ৯৫০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির কাছে ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৬৯ কোটি টাকা, এবি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ৩২৫ কোটি, সাউথ-ইস্ট ব্যাংক হালিশহর শাখার ১৪৮ কোটি ও ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১০৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। টাকা আদায়ের জন্য আইডিএলসি ফিন্যান্স, ৯ কোটি টাকা আদায়ে ব্যাংক এশিয়া ও ৭০ লাখ টাকা আদায়ে সিটি ব্যাংক মামলা করে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে রয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ এর সঙ্গে ভারতের দিল্লীতে ‘সরকার উৎখাত’ এর বৈঠকের অভিযোগে ২০১৬ সালের ১৫ মে ঢাকা থেকে গ্রেফতার হন আসলাম চৌধুরী। একই আসন থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন তার ভাই আমজাদ হোসেন। দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধেই একাধিক মামলা।
আফরোজা খানম রিতা দেশের মুন্নু গ্রুপের কর্ণধার ও সাবেক মন্ত্রী মরহুম হারুনর রশিদ খান মুন্নুর মেয়ে। তিনি মনোনয়ন কিনেছেন মানিকগঞ্জ-৩ আসন থেকে। তাদের প্রতিষ্ঠান মুন্নু ফেব্রিক্সকে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ে ২৩০ কোটি টাকা ঋণখেলাপী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঋণ নবায়নের জন্য এককালীন ডাউন পেমেন্ট বাবদ ১১ কোটি টাকা সোনালী ব্যাংকে জমা দেয় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে। ঋণ নবায়ন প্রস্তাব অনুমোদন হওয়ায় রিতার মনোনয়ন বাতিল হয়নি বলে সূত্রে জানা গেছে।
গিয়াস উদ্দিন কাদের চট্টগ্রাম-২ ফটিকছড়ি ও চট্টগ্রাম-৭ রাঙ্গুনিয়া আসনের জন্য বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। তার ছেলে সামির কাদের চৌধুরী চট্টগ্রাম-৬ রাউজান আসনের জন্য বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। একইসঙ্গে ঋণখেলাপীর অভিযোগে পিতাপুত্র দুইজনেরই মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। পিতাপুত্র দুই জনই অগ্রণী ব্যাংকে ঋণ খেলাপি। মতিঝিল শাখায় ঋণখেলাপির পরিমাণ ২৪৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা। জানা যায়, বছর তিনেক আগে পুঁজি সঙ্কটের কারণে ঢাকা ডায়িং নামে গিয়াস উদ্দিনের শিল্পকারখানাটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
চট্টগ্রামের কোতোয়ালি-বাকলিয়া আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন নিয়েছিলেন এমইবি গ্রুপের কর্ণধার শামসুল আলম। তার বিরুদ্ধে ১৫টি ব্যাংকে ৭৮০ কোটি টাকার ঋণখেলাপী তথ্য রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে অর্ধ শত মামলা।
বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল ফিশ এ্যান্ড ফ্রগলেসের কাছে সোনালী ব্যাংকের বকেয়া ঋণ ৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। প্রিমিয়ার ব্যাংকের কাছে আমীর খসরুর মিহির গার্মেন্টসের বকেয়া ২২ লাখ টাকা। তাঁরই আলফা প্যাকেজেসের (বিডি লি.) কাছে ঢাকা ব্যাংকের বকেয়া ঋণের পরিমাণ ২৮ লাখ টাকা। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর হোটেল সারিনার কাছে ঢাকা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের বকেয়া ঋণ ২৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
বিএনপির প্রার্থী এ্যাডভোকেট নাদিম মোস্তফা রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন । তিনি মনোনয়নপত্রে ১০টি মামলার তথ্য গোপন করেছেন। এছাড়াও বেসিক ব্যাংক থেকে আড়াই কোটি ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করায় খেলাপী হয়েছেন তিনি এবং মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে।
সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ঢাকা- ৬ আসনে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেনের মনোনয়নপত্রও এক লাখ টাকা ঋণ খেলাপের কারণে বাতিল হয়েছে। এছাড়া ঢাকা-৫ আসনে বিএনপির সেলিম ভূঁইয়া, ঢাকা-১৪ আসনে বিএনপির সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিক, টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) আসনে বিএনপির প্রার্থী ফকির মাহবুব আনাম স্বপন, টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনে বিএনপির প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী নূর মোহাম্মদ খান, কিশোরগঞ্জ-২ আসনে বিএনপির মেজর (অব.) আকতারুজ্জামান ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (নবীনগর) আসনে বিএনপির কাজী নাজমুল হোসেনের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের কয়েক শ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এজন্য বাতিল করা হয়েছে তাদের মনোনয়ন পত্র।
বিএনপির নেতাকর্মীদের বিশাল অপকর্মের জন্যই তাদের মনোনয়নপত্রের তালিকাটি ভারী।