

সিএইচটি টাইমস নিউজ ডেস্কঃ-‘আ. আ. ম. স. VC!’ এইটুকু পড়ে অর্থবহ কিছু মনে না হলেও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজ-এর টকশো ‘নিউজ আওয়ার এক্সট্রা’র শিরোনাম এটি।যে অনুষ্ঠানের আলোচনার মূল বিষয় ছিল-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ প্রসঙ্গে চলমান বিতর্ক।এর সঞ্চালনা করেছেন টকশো নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সমালোচিত সাংবাদিক মুন্নী সাহা। টকশো-তে আগত অতিথিদের সঙ্গে উপস্থাপক হয়ে নিজেই বাকবিতণ্ডায় জড়ানো এবং টকশো’র এমন বিতর্কিত সব শিরোনাম করায় মুন্নী সাহার সাংবাদিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এই পেশায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং বিশেষজ্ঞরা।সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে আলোচিত একটি বিষয় হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ।আর এই বিষয় নিয়েই এটিএন নিউজ-এর নিয়মিত টকশো ‘নিউজ আওয়ার এক্সট্রার’ আয়োজন করা হয়। ৭ আগস্টের এই অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয় ‘আ. আ. ম. স. VC!’। মুন্নী সাহা শুরুতেই অবশ্য অনুষ্ঠানের নামকরণের বিশ্লেষণও করেছেন।তিনি বলেন, ‘অনেকেই হয়ত জানেন আবার অনেকে হয়ত জানেন না।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি উপাচার্য আছেন তার নাম আ.আ.ম.স.আরেফিন সিদ্দিক। অনেকে ঠাট্টা করে বলেন,আজীবন আওয়ামী লীগের মনোনীত সদস্য।’ অনুষ্ঠানটি প্রচার হওয়ার পরপরই টকশোর বিদ্রুপাত্মক এই নাম নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়।কীভাবে একজন সিনিয়র সাংবাদিক দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নিয়ে এমন শিরোনাম দেন? একজন শিক্ষককে নিয়ে এ ধরনের বিদ্রুপ কোনোভাবেই মানা যায় না বলে মন্তব্য করছেন সাংবাদিকতার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।অন্যদিকে সিনিয়র সাংবাদিক,শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন,মুন্নী সাহা প্রায়ই সাংবাদিকতার নৈতিকতা লঙ্ঘন করেছেন। সাংবাদিকতার বিভিন্ন সেকশনে তিনি প্রায়ই বিতর্কিত কাজ করছেন।তিনি এই পেশায় জড়িত অন্যদেরকেও বিতর্কে ফেলছেন। সাংবাদিকতাকে কলুষিত করছেন বলেও মনে করছেন তারা।উল্লেখ্য,মুন্নী সাহা এটিএন নিউজের চিফ এক্সিকিউটিভ এডিটর।এই টকশো’র নামকরণ মুন্নী সাহা নিজেই করেন বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।এর আগেও মুন্নী সাহার সঞ্চালনায় এ ধরনের টকশো হয়েছে,যেগুলোর নামকরণ করা হয়েছে আলোচনা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কটাক্ষ বা বিদ্রুপ করে। চলতি বছরের জুলাই মাসে ফরহাদ মজহার অপহৃত হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে আয়োজিত টক শো’র শিরোনাম করা হয় ‘প্লেয়ার বনাম প্লেয়ার’।অনুষ্ঠানে আগত অতিথি অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান তৎক্ষণাই বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানান।মুন্নী সাহার প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে সলিমুল্লাহ খান বলেন,যে মানুষটি অপহৃত হয়েছে সে কীভাবে প্লেয়ার হতে পারে? কিংবা ‘প্লেয়ার বনাম প্লেয়ার’ শিরোনামটি দিয়ে কী বোঝানোর চেষ্টা করেছেন তিনি।২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর এক টকশোতে অতিথি হিসেবে বাসা থেকে স্কাইপে যুক্ত করা হয় জনপ্রিয় উপস্থাপক শফিক রেহমানকে।অনুষ্ঠানে যুক্ত করার পূর্বে তার সঙ্গে যে কথা ছিল সেটা মু্ন্নী সাহা রাখেননি বলে অভিযোগ করেন শফিক রেহমান।এছাড়া বিভিন্ন সময় টকশো-তে অতিথিদের ডেকে বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।এই ঘটনাগুলো সংবাদিকতাকে কলুষিত করছে বলে মন্তব্য করে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই-এর বার্তা সম্পাদক ও টকশো সঞ্চালক মীর মাসরুর জামান প্রিয়.কমকে বলেন, ‘কোনো উপস্থাপক যখন এমন শিরোনামে অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন তখন শুরুতেই তিনি আলোচিত ব্যক্তিকে ছোট করে উপস্থাপন করছেন।একজন সম্মানিত ব্যক্তির প্রতি এমন অবমাননাকর ও বিদ্রুপাত্মক শিরোনাম কখনও সাংবাদিকদের নিকট হতে কাম্য নয়।’
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের শিরোনামের মাধ্যমে তিনি প্রথমেই আলোচিত ইস্যুটিতে ভ্যালু অ্যাড করছেন। নিরপেক্ষতার পেশা সাংবাদিকতায় সাংবাদিকের এমন বিচারিক মানসিকতা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।’‘দেশের রাজনীতিতে তিনটি স্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ আর তা হচ্ছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,হাইকোর্ট এবং প্রেসক্লাব’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এই তিনটি স্থানকে অস্থিতিশীল কিংবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে যেকোনো সরকারের ভীত নড়িয়ে দেওয়া যায়।বিএনপি জামাত গোষ্ঠী এবং তাদের দোসররা প্রেসক্লাব নিয়ে অনেকদিন অপচেষ্টা করলেও এখন হতাশ।কোর্ট প্রাঙ্গণে তাদের অবস্থান এখনও সুদৃঢ়। মাঝে মধ্যেই এর বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।’ তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত সাড়ে ৮ বছরে তারা কোনো অবস্থানই তৈরি করতে পারেনি।উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্যার বঙ্গবন্ধু কন্যার সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুন্দর একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছেন।বিএনপি জামাত নিজেরা ঢুকতে না পেরে এখন ব্যবহার করছেন তাদের দোসর তথাকথিত সুশীলদের। এই সুশীলরা খুব সুক্ষভাবে প্রগতিশীলশিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।ওনাদেরকে ব্যবহার করছেন আরেফিন স্যার এর বিরুদ্ধে।’ ‘এই সুযোগে সুএই সুযোগে সুশীলরাও মাঠে নেমে পড়েছেন।ওনারা হয়তো স্বপ্ন দেখছেন আরেফিন সিদ্দিককে সরাতে পারলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও ক্যাম্পাস দিয়ে একটি নাড়া দেয়া যাবে’,উল্লেখ করেন তিনি।আশরাফুল ইসলাম খোকন লিখেছেন, ‘আপনাদের ভুলে যাওয়ার কথা না, সাবেক ডাকসু ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না এই ক্যাম্পাসেই ২/৩ টি লাশ ফেলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চেয়েছিলেন। টেলিফোনে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকাকে বলেছিলেন,ক্যাম্পাসে কয়েকটি লাশ ফেলতে পারলেই বাকি কাজটুকু ওনারা করবেন।এই লাশ ফেলার জন্যই হয়তো আরেফিন স্যারকে সরানো ওনাদের জন্য জরুরি।’ এটা কোন ধরনের ভদ্রতা?প্রশ্ন রেখে তিনি লিখেন, ‘যথাসময়ে যথানিয়মে যিনি উপাচার্য হবার তিনিই হবেন,এটা যে কেউ হতে পারেন।তাই বলে একজন ভদ্রলোকের চরিত্রহনন?এটা কোন ধরনের সভ্য আচরণ।ভুলে গেলে হবে না,আরেফিন সিদ্দিক স্যাররা ক্ষণজন্মা।যুগে যুগেও জন্মায় না।আজ পর্যন্ত ওনার বিরুদ্ধে তার চরম শত্রুরাও কোনো দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ আনতে পারেননি।’ এই শিরোনামকে সাংবাদিকতার নৈতিকতা বিরোধী বলে মনে করেন জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক ফারাবি হাফিজ।তাই বিষয়টির নিন্দা জানিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আরেফিন স্যার এবং মুন্নী দি’ দুজনই আমার সরাসরি শিক্ষক।একজন থিওরি পড়িয়েছেন,আরেকজন বাস্তব চিনিয়েছেন।দুজনেরই আমি আদরের।কিন্তু এভাবে একজন উপাচার্যকে নিয়ে নিয়ে ব্যাঙ্গ করার অধিকার আপনাকে দেওয়া হয়নি দিদি।’ ‘নৈতিকতা’ বিরোধী এমন শিরোনামের ইস্যুতে তিনি লিখেছেন, ‘এটা (অনুষ্ঠানের শিরোনাম) কোনো সংজ্ঞায়ই নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না বলে আপনার থেকে শেখা আমার ক্ষুদ্র সাংবাদিকতার জ্ঞান বলে।আর এও মনে হয় যে,আপনার ক্ষমা চাওয়া উচিত।আর আমাকে মাফ করবেন দিদি এভাবে পাবলিক পোস্ট দিতে হলো। আর যদি পিসিআরের লোকজন এটা করে থাকে আপনার অ্যাকশন নেওয়া উচিত।’ এদিকে ফেসবুকে অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিবার্তা২৪.নেট-এর সম্পাদক বাণী ইয়াসমিন হাসি লিখেছেন, ‘ছি, মিথ্যাচারেরও একটা সীমা থাকে।ঔদ্ধত্যেরও একটা পরিসীমা থাকা উচিত। তিনি (মুন্নী সাহা) ভিসি স্যারকে শুধু বলেছেন,তিনি স্যারকে নিয়ে একটি প্রোগ্রাম করতে চান।এর বাইরে কোনো কথা স্যারের সাথে তার হয়নি।শিরোনামের অনুমতি তিনি নেননি।ধিক্কার…’ প্রথম আলোর সাবেক স্টাফ রিপোর্টার ও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক কাজী আনিস ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কিছু বলিনি।চুপচাপ ছিলাম।কিন্তু এ বেয়াদবির প্রতিবাদ না করে থাকতে পারলাম না।বেয়াদবি না করা আর তার প্রতিবাদ করা আমার পারিবারিক শিক্ষা।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী বাপ্পাদিতা বসু লিখেন, ‘সাংবাদিকতা না,একে বেয়াদবি বলে।এটিএন নিউজ ও মুন্নী সাহা বেয়াদবি করেছেন।জাস্ট বেয়াদবি।এরা আবার টকশোর নামে জাতিকে জ্ঞান দেয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের উচিৎ এদেরকে পুরো ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করা এবং একই সাথে এদের বিরুদ্ধে মামলা করা।এটিএন নিউজ বেয়াদব। মুন্নী সাহা বেয়াদব।’ একজন মানুষ চরম অপরাধী হলেও গণমাধ্যমে তাকে এমন বিদ্রুপাত্মকভাবে উপস্থাপন করা যায় না বলে মন্তব্য করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি প্রদীপ কুমার পাণ্ডে।প্রদীপ কুমার বলেন,টকশো-তে এমন শিরোনাম সাংবাদিকতার নৈতিকতার অবক্ষয়েরই বহিঃপ্রকাশ।এর মাধ্যমে পুরো গণমাধ্যমই তার গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে।যেই উপস্থাপক একের পর এক শিরোনাম দিয়ে সাংবাদিকতাকে দিনে দিনে ‘কলুষিত’ করছেন তাকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে অনুষ্ঠান উপস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘তবে এতেও কোনো কাজ না হলে প্রয়োজন তাকে গণমাধ্যম থেকে বিদায় করে দিতে হবে। কারণ এই দায় শুধু তার একার নয় বরং এই দায় ওই গণমাধ্যমটির,এই দায় পুরো গণমাধ্যমের ওপর বর্তায়।’
এসব বিষয় নিয়ে মুন্নী সাহার সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি রিসিভ করেন নি।সূত্র-(((প্রিয়.কম)))