বান্দরবান সদরের ৪নং সুয়ালক ইউনিয়নের কাইচতলি ২ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ছেনুয়ারা (৩৫) এর রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে বান্দরবানে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে।বলা হচ্ছে গত বুধবার (৯ মার্চ) সকালে বান্দরবানের একজন সিনিয়র আইনজীবীর চেম্বারে ছেনুয়ারা তাঁর স্বামী পল্লী চিকিৎসক ওয়াসিমের সাথে ৪ বছর বয়সী সন্তানসহ ২০১৯ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে স্বামীর বিরুদ্ধে করা একটি মামলার আপোষনামা (নারী ও শিশু মামলা নম্বর ৬১/-২০১৯,ধারা-নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ১১ (ক)/৩০) তৈরির কাজে বান্দরবান আসেন।পরে কাজ শেষে তাঁরা মোটরসাইকেল যোগে সুয়ালকের কাইচতলির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।পথিমধ্যে রেইচা সেনা ক্যাম্প সংলগ্ন গ্রীন পিক রিসোর্টের সামনে তাদের মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়।এতে ছেনুয়ারা গুরুতর আহত হয় এবং তাকে তাৎক্ষণিক নিকটবর্তী বান্দরবান সদর হাসপাতালে না এনে প্রথমে কেরানিহাট এর মা ও শিশু হাসপাতালে নেয়া হয়।
কিন্তু গুরুতর আহত ছেনুয়ারার সাথে থাকা স্বামী ওয়াসিম নিজের পরিচয় নিয়ে লুকোচুরি করায় আহত নারীকে ভর্তি না নিয়ে চট্টগ্রাম নিয়ে যেতে পরামর্শ দেয়া হয়।পরে চট্টগ্রাম শহরের পাঁচলাইশ এলাকার সিএসটিসি নামক একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পর থেকে আইসিইউতে ভর্তি করা পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় ছেনুয়ারার বাবা আবুল হোসেনসহ তার দুই খালার কাছে দুর্ঘটনা এবং চিকিৎসার পুরো বিষয়টি অন্ধকারে রাখা হয় বলে অভিযোগ তুলেন নিহত নারীর আত্মীয় স্বজনরা।
বৃহস্পতিবার (১০ মার্চ) সকালে মৃত নারীর পিতা আবুল হোসেনকে তাঁর মেয়ের মৃত্যুর খবর জানানো হয়।পরে মৃত ছেনোয়ারার লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্স চট্টগ্রাম থেকে রওনা হবার তথ্য জানায়।এ্যাম্বুলেন্স কাইচতলিতে পৌছার পর ছেনোয়ারার মা মৃত মমতাজ বেগমে বাড়িতে রাখা হয় এবং দাফন প্রক্রিয়া শুরু হয়।দাফন কার্যক্রম শুরুর পর ছেনোয়ারার হাসপাতালের রিপোর্ট দেখতে গিয়ে তাঁর লাশের ডেথ সার্টিফিকেট কোথায় এই প্রশ্ন তোলা হলে অভিযুক্ত ওয়াসিম সদুত্তর দিতে না পারায় ছেনোয়ারার খালা কাজী নিরুতাজ বেগম এবং তাঁর খালাতো ভাই শহিদুল আলম বাবু এই মৃত্যু নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রশ্ন তুলেন।
রহস্যজনকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই কাগজটি না পেয়ে ছেনোয়ারার দাফন প্রক্রিয়া বন্ধ রেখে বান্দরবান সদর থানায় যোগাযোগ করেন।এসময় তাঁর আত্মীয় স্বজনরা তাকে যে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে সেই হাসপাতালে যোগাযোগ করলে হাসপাতাল কতৃপক্ষ জানায় মৃত ছেনোয়ারা যদি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতো তাহলে লাশের ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া কোনও অবস্থাতেই তাকে ছাড়পত্র দেয়ার সুযোগ নাই।এতে নতুন করে এই দুর্ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন উঠে এবং ছেনোয়ারার আত্মীয় স্বজনরা ময়না তদন্ত করার বিষয় নিয়ে বান্দরবান সদর থানায় যোগাযোগ করে।পরবর্তীতে মৃত ছেনোয়ারার আত্মীয় স্বজনরা বান্দরবান জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) অশোক কুমার পাল (পিপিএম-সেবা) এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মো.কুদ্দুস ফরাজি (পিপিএম) কে সার্বিক বিষয়টি অবহিত করেন।
পরে বান্দরবান সদর থানার অফিসার ইনচার্জ রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল পুলিশ সদস্য নিহত ছেনোয়ারার লাশ বান্দরবান সদর হাসপাতালে নিয়ে আসেন এবং সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন।পরেরদিন শুক্রবার সকালে ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়।এবিষয়ে রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণকারী ছেনোয়ারারার বাবা মো.আবুল হোসেন বলেন,ওয়াসিম আমার মেয়েকে পরিকল্পিতভাবে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়ে হত্যা করেছে।এই ঘটনার সাথে ওয়াসিমের পরকীয়া প্রেমিকাও জড়িত।
কারণ দুর্ঘটনার দিনও ওয়াসিম জোর করে দ্বিতীয় স্ত্রী কে মেনে নেয়ার শর্ত দিয়ে সাক্ষর নিয়েছেন বলে আমরা শুনেছি।তাছাড়া সে আমাদেরকে না জানিয়ে কোথাও যায়না।দুর্ঘটনার পর আমাকে না জানায়ে আমার মেয়েকে চট্টগ্রাম নিয়ে গেছে।এখানে অনেক রহস্য আছে।আমি এই ঘটনার সঠিক তদন্ত চাই।
এবিষয়ে বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মো.কুদ্দুস ফরাজি (পিপিএম) বলেন,পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।এটি না দেখে কিছু বলা যাচ্ছে না।তবে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা হবে।অ-স্বাভাবিক কিছু ঘটে থাকলে খতিয়ে দেখা হবে এবং কঠোর ব্যাবস্থা নেয়া হবে।
এবিষয়ে বান্দরবান সদর হাসপাতালের আর.এম.ও ডা.জিয়াউল হায়দার বলেন,লাশের ময়না তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি হতে কয়েক দিন সময় লাগবে।চলতি সপ্তাহের শেষ দিকে ছেনোয়ারার ময়না তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ম অনুযায়ী যথাযথ কতৃপক্ষ কে পাঠিয়ে দেয়া হবে।একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,ভিকটিম এর জন্য ময়না তদন্ত রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাশাপাশি পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টও কোনও অংশে গুরুত্বহীন নয়।মৃত ছেনোয়ারার ছোট খালা কাজী নিরুতাজ বেগম জানান,আমরা পুরো বিষয়টি সঠিকভাবে তদন্ত করার দাবী জানাচ্ছি কারণ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কারও কিছু হইলো না এমনকি মোটরসাইকেলটিরও কিছু হয়নি তখন কি এমন ঘটলো যে কারনে আমার ভাগ্নি অকালে মরে গেলো।আমরা এই ঘটনায় আমরা মামলা করবো।এবিষয়ে অভিযুক্ত ওয়াসিম এবং রুখসানা আক্তার কে ফোন করা হলে তাদের কাউকেই ফোনে পাওয়া যায়নি।তবে তাদের বক্তব্য নেয়ার জন্য কাজ করছে সিএইচটি টাইমস ডটকম।
এদিকে সিএইচটি টাইমস ডটকম এর নিজস্ব অনুসন্ধানে দেখা যায় মৃত ছেনোয়ারার হাসপাতাল বিলে ইংরেজিতে Status শব্দের বিপরীতে একই ভাষায় Alive শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে।অর্থাৎ অবস্থা হিসেবে তাকে জীবিত উল্লেখ করা হয়েছে।যেকারনে প্রশ্ন উঠেছে তাহলে মৃত সেনোয়ারা কবে- কখন-কোথায় মারা গেলেন।হাসপাতালের বিলটি নিচে সংযুক্ত করা হলো।