মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম,(ঘুনধুম সীমান্ত থেকে ফিরে):-মারজান বিবি, বয়স ৬৫।অপলক দৃষ্টিতে সীমান্তের ওপারে জ্বলতে থাকা একটি গ্রামের দিকে তাকিয়ে।আগুনের লেলিহান শিখা এপার থেকেও দেখা যাচ্ছিল।উপরে আকাশের মেঘের সাথে মিশে যাচ্ছিল ধোঁয়ার কুন্ডলি।বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলতে যাওয়ার পর ওপারের পুড়তে থাকা এলাকাটা দেখিয়ে বললেন,সেখানে তাদের বাড়ি।নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন তার স্বামী।সেখানেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং রাখাইন মগরা এক কোপে তার মাথা ফেলে দিয়েছিল।প্রাণ বাঁচাতে এলাকার আরও কয়েকজনের সঙ্গে নৌকায় করে চলে আসলেন এপারে।বৃদ্ধা মারজান বিবি যখন কথাগুলো বলছিলেন,তখন তার কণ্ঠ কেঁপে কেঁপে উঠছিল।আর বোরকার নেকাবের ওপর দিয়েও দেখা যাচ্ছিল,দু’চোখ বেয়ে নামছে অশ্রæধারা।চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মত মিলিয়ে মিলিয়ে কথা গুলো বলছিল সে।সীমান্তে গেলে আপনিও এমন হাজার হাজার মারজান বিবিদের দুর্দশার কাহিনী শুনতে পাবেন।তাদের ওপর কতটা নির্মম নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সে সব কাহিনী শুনতে গেলে অবশ্যই আপনার চোখের পানিতে ভাসবেন আপনি।কখন যে নিজেও কাদঁলাম খেয়াল করিনি।বান্দরবান নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুনধুম পশ্চিমকুল (করিডোর) শরণার্থী শিবিরের একজন বৃদ্ধের গল্প শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারছিলাম না। দুটি সন্তানকেই চোখের সামনে হত্যা করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।গলা কেটে,ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করেছে। বর্তমানে আশ্রয় শরণার্থী শিবিরে ছোট্ট একটি ঝুঁপড়িতে। কিন্তু সন্তানের শোকে দু’দিন যাবত মুখে কোনো খাবারই তুলতে পারছেন না এই মা।শোকে বলতে গেলে পাথরই হয়ে গেছেন।মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে (বর্তমানে রাখাইন রাজ্য) কয়েক দশক ধরেই রোহিঙ্গা নিধনে মেতে রয়েছে সেখানকার সেনাবাহিনী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ভিক্ষু ও রাখাইনরা।গত বছর অক্টোবরে একবার রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল মিয়ানমার।টানা কয়েকদিনের নৃশংসতায় প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ।হাজার হাজার রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে।তবে এবার আগস্টের শেষ দিকে আরাকানে যে নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনরা,তা পৃথিবীর যে কোনো নির্মম নৃশংসতাকে হার মানাতে বাধ্য।গুলি-বোমার সঙ্গে ছুরি-তলোয়ার দিয়ে শিশু-তরুণ-যুবকদের ওপর নৃশংস হামলা করে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। একই সঙ্গে গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে।মিয়ানমার সরকারই কয়েকদিন আগে স্বীকার করেছে,রাখাইনে ১৭৬ গ্রাম মানুষশূন্য।সোস্যাল মিডিয়া ফেইসবুক,টুইটারসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যেভাবে হত্যা,নির্যাতন আর আগুনের চিত্রগুলো ফুঠে উঠেছে,তা এক কথায় ভয়াবহ।মিয়ানমার সেনাবাহিনী জাতিগত নিধনে নেমেছে রাখাইন রাজ্যে।একজন মুসলিমও যেন সেখানে থাকতে না পারে সে লক্ষ্যেই এমন নিষ্ঠুরতা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।আপাত দৃষ্টিতে যেটা দেখা যাচ্ছে-রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি দাবি করে তাদেরকে এ দেশে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য এমন কাজ করছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ।তবে এর পেছনে আরো কোনো গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে কি না,তা হয়তো সময়ই বলে দেবে।মিয়ানমার সন্ত্রাসীদের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে ¯্রােতের মত রোহিঙ্গা ছুটে আসছে বাংলাদেশে।জাতিসংঘ বলছে,এবারের সহিংসতায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যাটা ইতিমধ্যে চার লাখ ছাড়িয়ে গেছে।নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশে এসে।রোহিঙ্গাদের দুর্দশা,তাদের আগমণ এবং বাংলাদেশে এসে তাদের আশ্রয় দেখতে গিয়েছিলাম নাইক্ষ্যংছড়ির চাকঢালা,বড় ছন খোলা,ঘুনধুম সীমান্তে।
শুধুমাত্র রোহিঙ্গা বললে ভুল হবে।মিছিলের ৯৫ ভাগ মানুষ নারী,শিশু আর বৃদ্ধ।সক্ষম পুরুষের সংখ্যা নেই বললেই চলে।তারা কোথায়?রোহিঙ্গা স¤প্রদায়ে কী যুবক-তরুণ নেই?এমনকি কিশোর বয়সী কোনো ছেলেকেও দেখতে পাচ্ছিলাম না।কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতেই জানা গেল-মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলার মূল টার্গেটই হচ্ছে যুবক-তরুণরা।তাদেরকে দেখামাত্র গুলি করে।ধরে নিয়ে যায়।জবাই করে,পুড়িয়ে মেরে,কিংবা কুপিয়ে যখম করে এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করে বর্বর মিয়ানমার বাহিনী এবং রাখাইনরা।ঘুনধুম সীমান্ত থেকে ওপারে মিয়ানমার, রাখাইন রাজ্য।দেখা যাচ্ছিল গ্রামগুলো জ্বলছে।দৃষ্টিসীমা যতদুর যায় ততদুর আগুনের লেলিহান শিখা।ধোয়ার কুন্ডলি মিশে যাচ্ছে আকাশে।যতক্ষণ ততক্ষণ দেখলাম ওপারের লোকালয় গুলোর কয়েক জায়গায় নতুন করে আগুন জ্বলে উঠতে।ওপারেই রোহিঙ্গাদের দেশ।যা এখন আর তাদের নয়।মিয়ারমারের বর্বর সেনারা সেখান থেকে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। যতদুর চোখ যায় মিয়ানমারের পাহাড়গুলো যেন সারি বেধে দাঁড়িয়ে আছে।সবুজের সমারোহ।অথচ আপনি কল্পনাই করতে পারবেন না,সেই সবুজের আড়ালে,পাহাড়ে ভাঁজে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী আর রাখাইনরা।পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামগুলো জ্বলছে।পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। কোনো জনমানুষের সেখানে থাকার সুযোগ নেই।অপরদিকে নতুন সমস্যা সীমান্তে স্থলমাইন পুঁতে রেখে বর্বরতার আরও চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার সময় যেন সেই মাইন বিস্ফোরণে উড়ে যায় তাদের দেহ।যারা বেঁচে আসবে এ পারে,তারা যেন আর ফিরে যাওয়ার সাহস না করে।ইতিমধ্যে মাইন বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছে বেশ কিছু মানুষ।পা উড়ে গেছে কয়েকজনের।একদল অসহায় মানুষের সঙ্গে নিকৃষ্টতম এমন আচরণ দেখে পুরো বিশ্বই আজ স্তম্ভিত।জীবন বাঁচানোর তাগিদে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা আসছে বাংলাদেশে।মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে এসব অসহায়ের পাশে দাঁড়াচ্ছে এ দেশের মানুষ।রোঙ্গিাদের বাংলাদেশে প্রবেশের মূল পথটাই নাইক্ষ্যংছড়ি ও উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত। পায়ে হেঁটে,নৌকা বা ট্রলারে করে এসে তারা নামছে এপারে।এরপর আশ্রয় মিলছে তাদের জন্য নির্মিত ক্যাম্পগুলোতে।চারটি খুঁটির ওপর একটি ত্রিপল বেঁধে মাথা গোঁজার ঠাঁই হচ্ছে রোহিঙ্গাদের।এপারে পৌঁছানোর পরই দিশেহারা রোহিঙ্গারা।কোথায় মিলবে একটু ঠাঁই,কে দেবে মুখে একমুঠো খাবার কিংবা একটু পানি?অসহায় মানুষগুলো শূন্য দৃষ্টিতে একে অন্যের দিকে চেয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে থাকে।সীমান্তে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম।রোহিঙ্গাদের জন্য স্রোতের মত সারা দেশ থেকে বাংলাদেশের মানুষ ত্রাণ সহযোগিতা নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।মিয়ানমার সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে নাফ তীরে নামার পর থেকেই এখন তারা দেখছেন,সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এ দেশের অসংখ্য মানুষ।যারা নাফের ওপারে নির্মম নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছেন,তারা এপারে এসে দেখলেন আশ্রয় এবং মানবিকতা নিয়ে প্রস্তুত বাংলাদেশ।কেউ তাদের পারাপারের ব্যবস্থা করছেন।কেউ খাবার এবং পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।কেউ নিয়ে এসেছেন খাবার স্যালাইন।কেউ দিচ্ছেন নগদ টাকা।যাতে রোহিঙ্গারা এই টাকা দিয়ে পরবর্তীতে নিজেদের জীবন নির্বাহ করতে পারে।বান্দরবানের লামা থেকে একটি দল আসল অসহায় রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তা নিয়ে।তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল, আমেরিকান প্রবাসী বাংলাদেশী মাইন আকবর,তার মেয়ে ফারাহ আকবর ও জামাতা মির আব্দুল ওয়ালী (আশিক) এই ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়েছেন।এই ভাবে লক্ষ বাংলাদেশী ও প্রবাসীরা এসেছে রোহিঙ্গাদের সহায়তা করতে।আরাকানের এসব অসহায় মানুষের ওপর নির্যাতন আর অমানবিকতা দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি। দেখার জন্য ছুটে এলাম।ওপারে না হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী বর্বরতা দেখাচ্ছে কিন্তু এপারে আমরা তো মানবিক। মানুষের জন্য দয়া-মায়া আছে।সে কারণেই এখানে এলাম।মানবিকতা দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম।মানবতার জয় হোক।
Publisher - Lutfur Rahman (Uzzal)
Published By The Editor From chttimes (Pvt.) Limited (Reg.No:-chttimes-83/2016)
Main Road,Gurosthan Mosque Market, Infront of district food Storage, Bandarban hill district,Bandarban.
Phone - News - 01673718271 Ad - 01876045846
Copyright © 2024 Chttimes.com. All rights reserved.