সরু গলি। দুই পাশে টিনের ঘর। একেকটি কক্ষে একেকটি পরিবারের বাস। বনানীর ১ নম্বর গোডাউন বস্তির তেমনই একটি ঘরে দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বাস করেন গাড়িচালক হারুনুর রশিদ। গত শনিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, হারুনের বড় ছেলে রিয়াদুল ইসলাম স্মার্টফোনে অনলাইনে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ক্লাস করছে।
রিয়াদুল বনানীর টিঅ্যান্ডটি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। গত ২৬ মার্চ করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার পর থেকে রিয়াদুলের স্কুলে অনলাইনে পাঠদান করা হচ্ছে। হারুন (রিয়াদুলের বাবা) দুই সন্তানের ক্লাস করার সুযোগ দিতে ঘরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ নিয়েছেন।
রিয়াদুল এখন বাবার মুঠোফোনে ওয়াই–ফাই ব্যবহার করে নিজের স্কুলের পাঠদানে অংশ নিচ্ছে। বাসায় ইন্টারনেট ব্যবহারযোগ্য স্মার্ট টেলিভিশনও রয়েছে। রিয়াদুল কখনো বাবার ফোনে, কখনো টিভিতে ক্লাস করে। হারুনুর রশিদ ব্রডব্যান্ডের জন্য মাসে ৩০০ টাকা খরচ করেন। হারুন বলেন, মুঠোফোনে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করে সন্তানের ক্লাসে যে খরচ পড়ত, তা বহন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না।
বনানী এক নম্বর গোডাউন বস্তির একটি ঘরে মুঠোফোনে ক্লাস করছে বনানীর টিঅ্যান্ডটি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রিয়াদুল ইসলাম।
শুধু বনানীর গোডাউন বস্তি নয়, ঢাকার আরও ছয়টি বস্তি ও নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাসের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেকেই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। বস্তির কোনো ঘরে শিশুরা অনলাইনে ক্লাস করে। কোনো কোনো পরিবারে কর্মজীবী মা-বাবা শিশুদের ঘরে রাখতে ব্রডব্যান্ডের সংযোগ নিয়ে দিয়েছেন, যাতে শিশুরা কার্টুন দেখতে অন্য জায়গায় না যায়। কোনো কোনো পরিবারে প্রশিক্ষণের কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে ইন্টারনেট।
বস্তির চায়ের দোকানিরা ব্রডব্যান্ড সংযোগকে বিক্রি বাড়ানোর কৌশল হিসেবে নিয়েছেন। দোকানে ইউটিউবে বিরতিহীনভাবে ক্রেতার পছন্দের অনুষ্ঠান চালানো হয়। ক্রেতা অবসর সময়ে বসে বসে তা দেখেন, চা পান করেন। দোকানে বিক্রি বাড়ে।
মালিবাগ রেললাইনের বস্তি এলাকায় চায়ের দোকান আছে মোট ৩০টি। এর মধ্যে ২৫টিতেই রয়েছে স্মার্ট টিভি ও ইন্টারনেট সংযোগ। ঢাকার পীরেরবাগের অলি মিয়ার টেক এলাকায় চায়ের দোকানগুলোতেও একই চিত্র। সেখানকার দোকানি মো. বিল্লাল কিস্তিতে ২৪ হাজার টাকা দামের একটি স্মার্ট টিভি কিনেছেন। ইন্টারনেটের রাউটার কিনেছেন এক হাজার টাকায়। মাসে ইন্টারনেটের বিল দেন ৫০০ টাকা।
বিল্লাল বলেন, ওই এলাকায় রিকশাচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও গাড়িচালকদের বাস। সারা দিন কাজ শেষে বিকেল ও সন্ধ্যায় দোকানে তাঁরা ভিড় করেন। রাত ১২টা পর্যন্ত ইউটিউবে চলে নানা অনুষ্ঠান। বিশেষ করে নাটক ও সিনেমা। ‘যে দোকানে ওয়াই–ফাই নেই, সেই দোকানে ক্রেতারা যান না।’—যোগ করেন বিল্লাল।
মালিবাগ রেললাইনের বস্তি এলাকায় চায়ের দোকান আছে মোট ৩০টি। এর মধ্যে ২৫টিতেই রয়েছে স্মার্ট টিভি ও ইন্টারনেট সংযোগ। ঢাকার পীরেরবাগের অলি মিয়ার টেক এলাকায় চায়ের দোকানগুলোতেও একই চিত্র।
দেশে গ্রাহক বাড়ছে
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাবে, আগস্ট মাস শেষে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি ১১ লাখ। ব্রডব্যান্ড সংযোগ নিয়েছেন ৮৬ লাখ ৫৬ হাজার গ্রাহক। করোনাকালে গত মার্চের পর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ বেড়েছে প্রায় ছয় লাখ। এখানে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, সর্বশেষ ৯০ দিনের মধ্যে একবার ইন্টারনেটে ঢুকলেই তাঁকে ব্যবহারকারী হিসেবে গণ্য করা হয়।
দেশে ২০১৩ সালে তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট (থ্রি–জি) চালুর পর থেকেই মূলত গ্রাহক বাড়ছে বলে জানান বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রযুক্তির পরিবর্তনকে মানুষ স্বাগত জানিয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারের সুফলও পাচ্ছে মানুষ।
ঢাকায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সবচেয়ে কম খরচের সংযোগের ব্যয় মাসে ৫০০ টাকা। তবে দু-একটি প্রতিষ্ঠান ৩০০ টাকায়ও বিশেষ প্যাকেজ দিয়ে থাকে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ওয়েবসাইট কেব্লডটইউকের হিসাব বলছে, ২০২০ সালে ব্রডব্যান্ডের গতির দিক দিয়ে ২২১টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮৪তম। দামের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৫৭তম।
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে নিম্নমান, গতি কম হওয়া ও বেশি টাকা নেওয়ার অভিযোগ পুরোনো। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বিটিআরসি ব্রডব্যান্ডের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন গতি ১০ এমবিপিএস বেঁধে দিয়েছিল। যদিও তা অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর হয়নি। ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিটিআরসির লাইসেন্সধারী আমাদের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কারও ১০ এমবিপিএস গতির নিচে প্যাকেজ নেই। আমাদের সদস্য প্রায় এক হাজার প্রতিষ্ঠান।
এর বাইরে বহু প্রতিষ্ঠান ইন্টারনেট সেবা দেয়।’
এমদাদুল হক আরও বলেন, ঢাকা শহরে বস্তির ঘর ও দোকান মিলিয়ে ২০ শতাংশের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। দেখা যায়, একটি সংযোগ নিয়ে অনেকে ব্যবহার করেন। সংযোগসংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।
রিকশাচালকের ঘরে ব্রডব্যান্ড
পীরেরবাগের অলি মিয়ার টেকের বউ বাজার এলাকায় থাকেন রিকশাচালক কুদ্দুস মিয়া। শনিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর বড় মেয়ে সাদিয়া (১০) ও ছোট মেয়ে চাঁদনি (৬) ইউটিউবে কার্টুন দেখছে। পাশে কাঁদছে তাঁর পাঁচ বছরের ভাই আল-আমিন। কারণ, সে পিৎজা তৈরির ভিডিও দেখতে চায়।
কুদ্দুস জানান, সকালে তিনি রিকশা নিয়ে বেরিয়ে যান। তাঁর স্ত্রীও গৃহকর্মীর কাজে চলে যান। বাচ্চাদের দেখাশোনার কেউ থাকে না। তাই বাচ্চাদের টিভি কিনে ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে দিয়েছেন তিনি।
অলি মিয়ার টেকের আরও কয়েকটি বস্তিঘরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দেখা গেল। মালিবাগের রেললাইন বস্তি ও মহাখালী সাততলা বস্তিতেও অনেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন ব্রডব্যান্ড সংযোগ নিয়ে।
বনানী ১ নম্বর গুদাম বস্তিতে ঘর আছে প্রায় ৬০০টি। অন্তত ৩০টিতে ব্রডব্যান্ড সংযোগ রয়েছে। গৃহিণী মোসাম্মত সেলিনা আক্তার ও তাঁর ননদ মোসাম্মত মাইনূর অনলাইনে সেলাইয়ের বিভিন্ন কাজ শিখেছেন। সেলিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন নিজেই নিজের পোশাক তৈরি করি। অন্যের পোশাক তৈরি করে কিছু কিছু উপার্জনও হয়।’
এখন নিজেই নিজের পোশাক তৈরি করি। অন্যের পোশাক তৈরি করে কিছু কিছু উপার্জনও হয়
সেলিনা আক্তার, বনানীর ১ নম্বর গুদাম বস্তির বাসিন্দা
শরিকি ব্যবহারের খরচ কম
ঢাকার আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দ্বিতীয় ভবন নির্মাণের জন্য নির্ধারিত জমিতে কয়েক শ পরিবার ঘর তুলে বসবাস করে। একটির বাসিন্দা শেখ মো. আজিম একটি সরকারি কোম্পানির অস্থায়ী গাড়িচালক। আজিম ৮০০ টাকায় একটি পুরোনো রাউটার কিনে ইন্টারনেট সংযোগ নিয়েছেন। এখন পাঁচজনে সেটি ব্যবহার করেন। প্রতি জন ১০০ টাকা করে দেন। আজিম বলেন, আগে ২০ এমবি ইন্টারনেট কিনে ২০ মিনিটও চালানো যেত না। এখন ইচ্ছেমতো ব্যবহার করি। দিনে খরচ তিন টাকার মতো।
আজিমের শরিক রিচার্জ ব্যবসায়ী ইমরান হোসেন বলেন, আগে মুঠোফোনে আর্থিক সেবার (এমএফএস) অ্যাপে লেনদেন করতে ১৬৮ টাকা প্যাকেজের ইন্টারনেট কিনতে হতো। ব্যবহার করতে হতো খুব হিসাব করে। এখন ১০০ টাকা খরচে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারি।
সাধারণ মানুষকে ৩০০ টাকায় ভালো মানের ইন্টারনেট সেবা দিতে গত জানুয়ারি মাসে উদ্যোগ নেয় বিডিকম অনলাইন নামের একটি আইএসপি, যাতে মানুষের খরচ কমে এবং গতিও ভালো থাকে। বিডিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম গোলাম ফারুক আলমগীর আরমান প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশে নিম্ন আয়ের মানুষকে স্বল্পমূল্যে উন্নত সেবা দিতে ব্যান্ডউইডথ পরিবহনের ব্যয় কমানো ও অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক দরকার।
বস্তিই প্রমাণ’
সুযোগ থাকলে গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষও যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন, বস্তিই তার প্রমাণ বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন ব্রডব্যান্ডকে গ্রামে নিয়ে যাওয়া জরুরি। কারণ ইন্টারনেট ব্যবহারের অনেক আর্থসামাজিক ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে।
গুজব বিশ্বাস করা, কুরুচিকর কনটেন্ট বা আধেয় দেখা, অপরাধমূলক কাজের মতো ইন্টারনেটের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে মইনুল হোসেন বলেন, সাধারণ মানুষ অনেক সময় কোনটি গুজব, কোনটি ভুয়া খবর, কোনটি অপরাধমূলক কাজ—এসব বুঝতে পারে না। এ ক্ষেত্রে সরকারকে ভূমিকা নিতে হবে। কাজটি করতে হবে দ্রুত। কারণ, ইন্টারনেটের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে।
Publisher - Lutfur Rahman (Uzzal)
Published By The Editor From chttimes (Pvt.) Limited (Reg.No:-chttimes-83/2016)
Main Road,Gurosthan Mosque Market, Infront of district food Storage, Bandarban hill district,Bandarban.
Phone - News - 01673718271 Ad - 01876045846
Copyright © 2024 Chttimes.com. All rights reserved.