:: উৎপল দাস ::
গত বুধবার (২৬ জুন) সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে স্ত্রীর সামনে শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত মোট ১৩ জনকে শনাক্ত করার কথা জানিয়েছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। গ্রেফতার করা হয়েছে অভিযুক্ত ৭ আসামিকে। তবে বিপক্ষের একটি গ্রুপ মামলার তদন্ত ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে সংশ্লিষ্টতা নেই এমন ব্যক্তিদের ঘিরে বিভিন্ন মাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ পরিবেশন করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে৷
প্রসঙ্গত, বরগুনা পুলিশ লাইন এলাকার মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের মেয়ে মিন্নির সঙ্গে মাস দুয়েক আগে সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের বড় লবণগোলা গ্রামের আব্দুল হালিম দুলাল শরীফের ছেলে রিফাত শরীফের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে কলেজ এলাকার সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড মিন্নিকে উত্ত্যক্ত করে আসছে। রিফাতের প্রতিবাদ করলে নয়নের সঙ্গে তাঁর বিরোধ সৃষ্টি হয়। এর জের ধরে স্ত্রীর সামনে রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করে নয়ন ও তার সহযোগীরা।
এ প্রসঙ্গে এলাকাবাসীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, খুনের মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহমেদ নয়ন স্থানীয়দের কাছে নয়ন বন্ড হিসেবেই বেশি পরিচিত। জেমস বন্ড ০০৭ ছবির নায়কের সাথে মিল রেখে নিজের নামের পরে বন্ড শব্দটি যুক্ত করে। তিনি প্রথম জীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকলেও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের বাসায় কেয়ারটেকার হিসেবে কাজ করার সুবাদে কোন পদ পদবি না থাকলেও ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে নিজেকে যুক্ত করার মাধ্যমে কালো অধ্যায়ের সাথে যুক্ত হন। তার শুরুটাই হয় একটি হত্যাচেষ্টার মাধ্যমে। ২০১১ সালের ১৭ জুলাই সেই ঘটনার পর নয়ন, স্থানীয় রাজনীতির সেই প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় থেকে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকে। ওই ঘটনার ঠিক এক মাস পরে ১৮ আগস্ট আবারও আরেকজনকে হত্যার চেষ্টা চালায় সে। এই দুটি ঘটনায় থানায় হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে মামলা দায়েরের পর নয়নের নাম বরগুনায় আলোচনায় উঠে আসে। রাজনৈতিক নেতাদেরও দৃষ্টি পড়ে তার ওপর।
পাশাপাশি রিফাত হত্যা মামলার অন্যতম প্রধান আসামি রিফাত ফরাজী ও তার ভাই রিশান ফরাজী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেনের ভায়রার ছেলে। রিফাতের বিরুদ্ধে মাদক কারবারের অভিযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগে বরগুনা সদর থানায় অন্তত চারটি মামলা রয়েছে। বরগুনা সরকারি কলেজে বখাটেপনার দায়ে পুলিশ তাকে দুইবার আটক করেছিল। কিন্তু খালুর রাজনৈতিক প্রভাবে কলেজ কর্তৃপক্ষ তখন কোনো মামলা না দেয়ায় পুলিশ মুচলেকা রেখে রিফাতকে ছেড়ে দেয়। সম্প্রতি খালুর সম্মতি নিয়ে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোয় রিফাত ঘটা করে জন্মদিন পালন করে।
বরগুনা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, আমি ২০১৪ সালের জুলাইতে এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিয়েছি। এ সময়ে ক্লাস চলাকালে রিফাত অন্তত দুইবার ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছিল। তাই রিফাতকে পুলিশে দিয়েছিলাম। কিন্তু জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন এর অনুরোধে মানবিক দিক বিবেচনা করে তখন তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা দেইনি। তিনি আরো বলেন, শুনেছি নয়নের বাসা ক্যাম্পাসের পাশেই। তবে আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না।
এ প্রসঙ্গে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, মামলার চার নম্বর আসামি চন্দন ও ছয় নম্বর আসামি মো. রাব্বি আকন ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত৷ তারা জেলা ছাত্রলীগের সদস্য। এছাড়া কিলিং মিশনে অংশ নেয়া আরেক যুবক সুহার্ত, জেলা যুবলীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন সাবুর ছেলে। গ্রুপ ০০৭ থেকে ফাঁস হওয়া এক ছবিতে তাকে রামদা হাতে বসে থাকতে দেখা গেছে। বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জুবায়ের আদনান অনিকের সাথে অভিযুক্তদের বিভিন্ন সময়ে ঘনিষ্ঠভাবে দেখা গেছে। তাছাড়া কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া অন্যান্য আসামিরাও জুবায়ের আদনান অনিকের অনুসারী বলে জানা যায়৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ছবি বিশ্লেষণ করে জানা যায় ছাত্রলীগের বিভিন্ন মিটিং মিছিলে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের একাধিক নেতাকর্মী এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, রিফাত শরীফকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে খুন করার কিছুক্ষণের মধ্যে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি, জুবায়ের আদনান অনিক তার ব্যবহৃত ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি নিষ্ক্রিয় করে দেন। কিলিং মিশনে অংশ নেয়া যুবকদের সাথে তার সম্পৃক্ততা আড়াল করতেই তিনি ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি নিষ্ক্রিয় করেছিলেন বলে আমরা মনে করি। সমালোচনা ঢাকতে তিনি গতকাল তার ব্যবহৃত অ্যাকাউন্টটি সক্রিয় করার সাথে সাথেই কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া যুবকদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ মূহুর্তের বিভিন্ন ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
তারা বলেন, জেলা ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে অনিক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছেন অনেক দিন ধরেই। তিনি টাকার বিনিময়ে শেখ হাসিনা হত্যা মামলার আসামির ভাই, সরোয়ার হোসেন স্বপনকেও পর্যন্ত তালতলী উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বানিয়েছেন। তারা আরও বলেন, অনিক টাকার বিনিময়ে ধর্ষণ মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি জাহিদুল ইসলামকে জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং আসাদুজ্জামান রাজুকে সহ-সম্পাদক বানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, অনিকের কাছে নীতি নৈতিকতা কিংবা আদর্শের কোনো মূল্য নেই। টাকা পেলে শেখ হাসিনা হত্যা মামলা আসামির ভাইকে যেমন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বানাতে পারেন, তেমন ধর্ষণ মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিকেও কমিটির গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ঠাঁই দিতে পারেন।
এইদিকে বরগুনা প্রেসক্লাবে গতকাল শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে, শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফ হত্যায় জড়িতদের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই বলে দাবি জানিয়ে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, প্রয়োজনে নিজের বৈধ অস্ত্র দিয়ে গুলি করে হলেও হত্যাকারীদের ধরবো। একইসঙ্গে হত্যাকাণ্ডের প্রধান দুই অভিযুক্ত সাব্বির আহমেদ নয়ন (নয়ন বন্ড) এবং নিজের ভায়রার ছেলে রিফাত ফরাজীর মৃত্যুদণ্ডও চেয়েছেন তিনি।
উল্লেখ্য, রিফাতকে হত্যার পর থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগ ওঠে, দেলোয়ার হোসেনের ক্ষমতার অপব্যবহার করে রিফাত ফরাজী ও তার ভাই রিশান ফরাজী তাদের অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করতো। এ কারণেই এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করার কথা জানান দেলোয়ার হোসেন।
এ প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বরগুনার প্যানেল মেয়র, রইসুল আলম রিপন বলেন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, দেলোয়ার হোসেন জাতির সামনে ধরা পড়ে নিজেকে বাঁচাতে এখন সংবাদ সম্মেলনে এসে এসব বলছেন। তার লাঠিয়াল আর সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে বরগুনার মানুষতো এমনিতেই ভীত সন্ত্রস্ত। তাই তিনি যে এখানে এসেও ধরা-মারার কথা বলবেন, এটা আমি জানতাম। তিনি বলেন, রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড দেলোয়ার হোসেন নিয়ন্ত্রিত সন্ত্রাসী বাহিনীর অন্যতম প্রধান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়েও উনি, পাঁচ বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, 'মারবো এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে'। উনি আসলে মারামারি, কাটাকাটি, খুন-খারাপি ছাড়া কিছুই বোঝেন না। তাই কথায় কথায় এসবই বলেন।
Publisher - Lutfur Rahman (Uzzal)
Published By The Editor From chttimes (Pvt.) Limited (Reg.No:-chttimes-83/2016)
Main Road,Gurosthan Mosque Market, Infront of district food Storage, Bandarban hill district,Bandarban.
Phone - News - 01673718271 Ad - 01876045846
Copyright © 2024 Chttimes.com. All rights reserved.