চালকদের কর্মবিরতির কারণে চলছে না বাস
নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে কোনও ধরনের ঘোষণা ছাড়া সোমবার (১৮ নভেম্বর) থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় ধর্মঘট ও কর্মবিরতি পালন করছেন বাসচালক ও শ্রমিকরা। মঙ্গলবারও এ ধর্মঘট অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে যাত্রী দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।
খুলনা প্রতিনিধি জানান, নতুন সড়ক পরিবহন আইনের কিছু ধারা সংশোধনের দাবিতে আজও বাসচালকরা কর্মবিরতি চালিয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে সব রুটে বাস, মিনিবাস ও পরিবহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এর ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা।
রাইসা ইসলাম নামে এক যাত্রী বলেন, বাস চলছে না জানি। তারপরও জরুরি দরকারে কেশবপুর যেতে হবে। এ কারণে বাসস্ট্যান্ডে এলাম। ভাবলাম চুকনগর হয়ে ভেঙে ভেঙে গাড়ি পাবো। কিন্তু না, এখন ইজিবাইক কন্ট্রাক্ট করে যেতে হচ্ছে।
সাধারণ যাত্রীদের পাশাপাশি বিপাকে রয়েছেন খুলনায় বসবাসকারী সরকারি কর্মজীবীরা— যারা এখান থেকে বাগেরহাট, যশোর, নওয়াপাড়া, ফুলতলা, মোংলা, ফকিরহাট, মোল্লাহাট, গোপালগঞ্জে গিয়ে প্রতিনিয়ত অফিস করেন।
কাউন্টারে যাত্রীদের ভিড়
বাসচালক জাহিদুল ইসলাম জানান, রাজপথে তাদের জেল জরিমানার ভয় আছে। সড়কে গাড়ি নিয়ে নামলে টুকটাক সমস্যা হবেই। সেটা যে কারও ক্ষেত্রেই হতে পারে। আমরা কোনও অপরাধ না করলেও সমস্যা কিছু থাকবে। ছোটখাটো কারণে প্রশাসন জেলে ঢোকাবে, জরিমানা করবে, সেটেই ভয়ের। তার চেয়ে গাড়ি না চালানোটাই চালকদের জন্য নিরাপদ।
মঙ্গলবার সকালে খুলনার সোনাডাঙ্গা আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালে অসংখ্য যাত্রীর ভিড় হয়। টার্মিনালে থাকা কোনও বাস না ছাড়ায় এসব যাত্রী বিপাকে পড়েন। জরুরি প্রয়োজনে অনেক যাত্রী কয়েকগুণ বেশি টাকা দিয়ে ইজিবাইক ও মাহিন্দ্রা ভাড়া করে মোংলা, বাগেরহাট, কাটাখালী, ফকিরহাট, ডুমুরিয়া, চুকনগর, তালা, পাইকগাছা, কয়রা, কেশবপুরসহ বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
সরেজমিন খুলনার সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, খুলনা থেকে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুড়া, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ রুটের বাসচালক ও শ্রমিকরা কাজে যোগদান করেননি।
খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বিপ্লব বলেন, ‘সড়কে অবৈধ নসিমন-করিমন চলে তাদের কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে। এসব যানবাহন বন্ধ ও চালকদের জরিমানা করা হয় না। বাসচালকদের ক্ষেত্রে জেল-জরিমানা হতে দেখা যায়।’
সড়কে বাস না চলায় ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা
তিনি আরও বলেন, ‘সোমবার সকালে শ্রমিকরা কর্মবিরতিতে যাওয়ার পর যাত্রীদের কথা চিন্তা করে তাদের (চালকদের) অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ শ্রমিকরা তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টাননি। তবে যদি কোনও চালক বাস চালাতে চান, তাকে যেন কেউ বাধা দিতে না পারে, সে বিষয়ে নজর রাখা হয়েছে।’
চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, নতুন সড়ক আইন সংশোধনের দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো চুয়াডাঙ্গায় অনির্দিষ্টকালের বাস ধর্মঘট চলছে। মঙ্গলবার চুয়াডাঙ্গা থেকে দূরপাল্লার ও আন্তঃজেলা রুটে সব ধরনের যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। গন্তব্যস্থলে যেতে হচ্ছে ইজিবাইক ও শ্যালোচালিত যানবাহনে। এই সুযোগে এসব যানবাহনে ভাড়া দ্বিগুণ নিচ্ছে বলে অভিযোগ যাত্রীদের।
বাসের চাকা বন্ধ থাকায় টার্মিনালেই সময় কাটছে শ্রমিকদের
এদিকে, নতুন সড়ক আইনকে অযৌক্তিক বলে দাবি করছেন চালকরা। দ্রুত এ আইনটি সংশোধনের দাবিও তাদের।
মোংলা প্রতিনিধি জানান, মোংলায় সোমবার থেকে শুরু হওয়ার পরিবহন ধর্মঘট আজও অব্যাহত রয়েছে। নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে মঙ্গলবার সকাল থেকে মোংলা-খুলনা, মোংলা-রূপসা, মোংলা-বাগেরহাটসহ অন্য সব রুটে বাস-মিনিবাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন এ সব রুটের যাত্রীরা। তবে আজ ভোরে মোংলা থেকে দূরপাল্লার যান ছেড়ে গেছে। মোংলা-খুলনা বাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব এ তথ্য জানান।
যশোর প্রতিনিধি জানান, নতুন সড়ক আইন সংশোধনের দাবিতে যশোরের পরিবহন শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় বাস চলাচল বন্ধ অব্যাহত রেখেছেন। মঙ্গলবার যশোর থেকে দূরপাল্লার কোনও বাস যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন শ্রমিকনেতারা।
বাংলাদেশ পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মামুনূর রশিদ বাচ্চু বলেন, সোমবার রাতে যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ আমাদের ডেকেছিলেন। তিনি অনুরোধ করেন- অন্তত ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার বিষয় কনসিডার করে যেন যশোরে বাস চলাচল সচল রাখা যায়। কিন্তু আমরা তাকে আশ্বস্ত করতে পারিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার সময়ে এই ঘটনা কষ্টদায়ক। কিন্তু বিষয়টি সাধারণ শ্রমিকরা সেভাবে বিবেচনায় আনছে না। আসলে আমরাও তাদের জোর করতে পারছি না।কারণ শ্রমিকরা গাড়ি চালালে এবং কোনও বিপদ ঘটলে আমাদের দায় নেওয়ার যে দাবি করা হচ্ছে- আমরা তা নিতে ভয় পাচ্ছি। সে কারণে আজ থেকে ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম সব দূরপাল্লার বাসও চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, নতুন সড়ক আইন সংশোধনের দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো ঝিনাইদহের স্থানীয় সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ রেখেছে বাস শ্রমিকরা। সোমবার সকাল থেকে ঝিনাইদহ-যশোর, ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া, মাগুরা ও চুয়াডাঙ্গার অভ্যন্তরীণ রুটে বাস চলাচল বন্ধ রেখেছে তারা। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে যাত্রীরা।
বাস না পেয়ে অনেকে ইজিবাইক ও মহাসড়কে চলাচলে নিষিদ্ধ তিন চাকার যানবাহনে চলাচল করছে। ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন না চাকিরিজীবিরা। তবে স্থানীয় সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও ঢাকাসহ দূরপাল্লার বাস ও ট্রাকসহ অন্যান্য পরিবহন চলাচল করতে দেখা গেছে।
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, পরিবহন ধর্মঘটের কারণে সাতক্ষীরা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে মঙ্গলবার সকাল থেকে কোনও বাস ছেড়ে যায়নি। বন্ধ রয়েছে অভ্যন্তরীণ রুটের সব বাস চলাচলও। তবে যাত্রীবাহী বাস বন্ধ থাকলেও দুই একটি বিআরটিসি বাস চলাচল করতে দেখা গেছে।
এদিকে বাস চলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন দূর-দূরান্তের যাত্রীরা। ইজিবাইক, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে যাতায়াত করছেন তারা।
সাতক্ষীরা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি সাইফুল করিম সাবু বলেন, শ্রমিকরা স্বপ্রণোদিত হয়ে ধর্মঘট করছে। তারা নতুন আইনের আতঙ্কে বাস চালাতে চায় না।
মাগুরা প্রতিনিধি জানান, গত তিনদিন ধরে মাগুরা-যশোর রুটের বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও ধর্মঘটের কারণে আজ থেকে বন্ধ হয়ে গেছে দূরপাল্লার অধিকাংশ বাস । হঠাৎ এ ধর্মঘটের ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা।
ঢাকা-খুলনা রুটের কোনও বাস আজ মাগুরা দিয়ে যায়নি। তবে লোকাল বাস চলাচল করছে কয়েকটি রুটে।
মাগুরার বাস মালিক মাজেদুল হক বলেন, ধর্মঘটের ফলে যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। এর সঙ্গে মালিক পক্ষের সংশ্লিষ্টতা নেই।
বরিশাল প্রতিনিধি জানান, নতুন সড়ক নিরাপত্তা আইনে জেল-জরিমানার ভয়ে বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন বরিশালের পরিবহন শ্রমিকরা। কোনও ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই মঙ্গলবার বেলা ১১টার পর থেকে বরিশালের অভ্যন্তরীণ ৮টি রুটে বাস চলাটচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। তারা মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত এই সমস্যা সমাধানের দাবি জানিয়েছেন।
ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জানান, সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা রুটের দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে শ্রমিকরা। মঙ্গলবার সকাল দশটার পর থেকে চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঘোষণা ছাড়াই বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় ঢাকাগামী যাত্রীরা পড়েছেন বিপাকে।
রাজশাহী প্রতিনিধি জানান, ধর্মঘটের কারণে মঙ্গলবার সকাল থেকে বাইরে থেকে কম গাড়ি ঢুকছে রাজশাহীতে। এতে করে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। তবে নগরীর শিরোইল ও নওদাপাড়া বাস টার্মিনাল থেকে যাত্রীদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন রুটে বাস ছেড়ে যাচ্ছে। চালক ও শ্রমিকদের মধ্যে নতুন আইন অনুযায়ী জরিমানা ভয় কাজ করছে।
রাজশাহী থেকে বরিশালগামী আকিব পরিবহনের চালক হামিদুল হক বলেন, আইন বেশি কড়া হয়ে গেছে। চালকরাও তো মানুষ, ভুল-ত্রুটি হতে পারে। আর দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই। কোনও চালক ইচ্ছে করে দুর্ঘটনা ঘটান না। তাই চালকদের বিষয়টি বিবেচনা করে আইন আরেকটু শিথিল করলে ভালো হয়। আমরা আশা করছি, শ্রমিক নেতারা সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে বসে একটা সমাধান করবেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের প্রতিবাদে দ্বিতীয় দিনের মতো চাঁপাইনবাবগঞ্জে বন্ধ রয়েছে বাস চলাচল। মঙ্গলবার সকাল থেকে জেলার অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃজেলা রুটে কোনও বাস চলতে দেখা যায়নি। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে যাত্রী সাধারণের। তবে দূরপাল্লার বাস চলাচল অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি সরকারি পরিবহন বিআরটিসি’র বাস ও রেল চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
এদিকে বাস চলাচল বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। বাস টার্মিনালগুলো ঘুরে দেখা গেছে, টার্মিনালগুলোতে বাস না পেয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে বিকল্প পরিবহনে (ইজিবাইক, মিশুক, মাহিন্দ্র, মাইক্রোবাস) তারা চলাচল করছেন। এতে তাদের অতিরিক্ত সময় ও ভাড়া গুনতে হচ্ছে।
নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে নওগাঁয় দ্বিতীয় দিনের মতো চলছে চালকদের কর্মবিরতি। ফলে নওগাঁর সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। সোমবার থেকে এখন পর্যন্ত নওগাঁর অভ্যন্তরীণ এবং দূরপাল্লার কোনও বাস চলাচল করেনি। এর ফলে যাত্রীদের পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ।
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে কুষ্টিয়ার বাস চালকদের কর্মবিরতি চলছে। মঙ্গলবার কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে যায়নি কোনও বাস। বন্ধ রয়েছে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে চলাচলকারী দক্ষিণবঙ্গের সব বাস। এতে দুর্ভোগে পড়েছে যাত্রীরা।তবে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক পাওয়া গেলেও চালকরা কয়েকগুন বেশি ভাড়া নিচ্ছেন। বেশি ভাড়া দিয়েও গন্তব্যে যেতে বাধ্য হচ্ছেন যাত্রীরা।