রোহিঙ্গা সংকট আর সেভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগের কেন্দ্রে নেই। বাস্তুচ্যুত এ জনগোষ্ঠীর জন্য প্রতিবছরই কমছে তাদের সহায়তার পরিমাণ। ফলে মিয়ানমার বাহিনীর গণনিষ্ঠুরতায় বাস্তুচ্যুত প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকেই বহন করতে হচ্ছে।
রোহিঙ্গারা সমুদ্রে দিনের পর দিন অসহায় অবস্থায় ভাসমান থাকলেও বাংলাদেশ ছাড়া কোনো দেশই তাদের গ্রহণ করেনি। যদিও সম্প্রতি রাশিয়ার হামলার পর ইউক্রেনের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো সাদরে বরণ করে নিয়েছে। এখনও নিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, 'ইউরোপের দেশগুলোর এই দ্বিমুখী নীতি নতুন কিছু নয়। শুধু রোহিঙ্গা নয়, এর আগে মধ্যপ্রাচ্যসহ আফ্রিকার শরণার্থীদেরও ইউরোপের দেশগুলো গ্রহণ করেনি। শুধু জার্মানি কিছু শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর গত মার্চে হঠাৎ করেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য চিঠি দেয় মিয়ানমার। প্রথম ধাপে ব্যক্তি পরিচয়ে ৭০০ রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে দেশটি। তবে বাংলাদেশ পরিবার ভিত্তিতে এক হাজার ১০০ জনকে পাঠানোর কথা জানায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এ অবস্থার মধ্যেই এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আটকে আছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সমকালকে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপদে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের মধ্য দিয়ে সংকটের স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এটা এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে স্পষ্ট যে, এ সংকট বাংলাদেশের জন্য বড় বোঝা হয়ে গেছে। অতএব সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর ভূমিকা জরুরি।
ফলো করুন- 
রোহিঙ্গা সংকট সত্তরের দশক থেকেই চলে আসছে। ১৯৭৭ সালে, ১৯৯২ সালে, ১৯৯৯ সালে দফায় দফায় রোহিঙ্গারা মিয়ানমার বাহিনীর নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসেছে। তবে রোহিঙ্গা সংকট সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় ২০১৭ সালে। ওই বছর আগস্ট মাসে মিয়ানমারে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার বাহিনী জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু করলে দলে দলে রোহিঙ্গা প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে। মাত্র তিন মাসে পালিয়ে আসে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। এর সঙ্গে আগে থেকেই ক্যাম্পে থাকা প্রায় সাড়ে তিন লাখ মিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এগারো লাখ।
২০১৭ সালে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেওয়াকে মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রশংসা করে আন্তর্জাতিক মহল। রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা জানিয়ে বড় আকারে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের অংশ নেয় তারা। জাতিসংঘ সত্যতা যাচাই কমিশন গঠনের মাধ্যমে রাখাইনে মিয়ানমার বাহিনীর গণহত্যা ও গণ নিষ্ঠুরতার প্রমাণ পায়। পশ্চিমা বিশ্ব রোহিঙ্গা গণহত্যার নিন্দা জানায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট মনোযোগ হারাতে থাকে। বিশ্বের অন্যান্য স্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিলেও মিয়ানমার বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে বড় আকারে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়েছে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিলে তার ফলে মিয়ানমারের সাধারণ মানুষেরও দুর্ভোগ হবে। এ কারণে এ ধরনের বড় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে না।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৭ সালের পর থেকে প্রতিবছরই রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার পরিমাণ কমছে। ২০২১ সালে ৯৪ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। তবে সেই লক্ষ্যমাত্রার ৬০ শতাংশ অর্জিত হয়। ২০২০ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিংসঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ৮৭ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার তহবিলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি মেলে ৬০ কোটি মার্কিন ডলারের। এর আগের বছর ২০১৯ সালে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংকট মোকাবিলায় ৯২ কোটি ডলারের চাহিদা ছিল। ওই বছরের ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হয় ৬২ কোটি ডলার। অর্থাৎ ২০১৯ সালে মোট চাহিদার ৬৭ শতাংশ অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালে ৯৫ কোটি চাহিদার বিপরীতে সাড়ে ৬৫ কোটি ডলার পাওয়া গিয়েছিল। চাহিদার তুলনায় জোগান সবচেয়ে বেশি এসেছিল ২০১৭ সালে, মোট চাহিদার ৭৩ শতাংশ। সর্বশেষ চলতি বছর ৮৮ কোটি মার্কিন ডলার তহবিলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে সহায়তা এভাবে কমতে থাকায় সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যয় বেড়ে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ সমকালকে বলেন, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশগুলো কেউই খুব জোরালোভাবে উচ্চকণ্ঠ হয়নি। তারা বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু যে ধরনের গুরুত্ব দিলে এ সমস্যার সমাধান নিশ্চিত হয়, তা করেনি। আজ ইউরোপকে দেখা যাচ্ছে ইউক্রেনের বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য খুবই উদার। এই উদারতা অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু এখানেও দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এ ধরনের উদারতা রোহিঙ্গা কিংবা সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের শরণার্থীদের জন্য দেখা যায়নি।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেন, যখন বাদামি চুল, নীল চোখের মানুষকে একভাবে দেখা হয়, আর কালো চোখ, কালো চুলের মানুষকে আরেকভাবে দেখা হয় সেটা একটা বর্ণবাদী চিন্তার প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে। পশ্চিম ইউরোপের ধনী দেশগুলো বর্ণবাদী নয়, তারা বহু দেশকে নানাভাবে মানবিক সহায়তা দেয়, কিন্তু একেক দেশের শরণার্থীরা যখন একেকভাবে বিবেচিত হয়, তখন প্রশ্ন উঠতে পারে। আর একটা কথা মনে রাখতে হবে, ইউরোপের মাটিতে যে সংকট আর দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশে যে সংকট, তা ইউরোপের দেশগুলোর কাছে সমানভাবে বিবেচিত হবে না, এটাই স্বাভাবিক। এখন দক্ষিণ এশিয়ায় যদি কোনো সংকট হয় সেটাকে এ অঞ্চলের দেশগুলো যেভাবে দেখবে, ইউরোপের দেশগুলো দূর থেকে একইভাবে দেখবে, সেটা ভাবার কারণ নেই। তবে মিয়ানমারের জান্তা সরকার 'কমিটেড জেনোসাইড' করেছে বলে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করে নিয়েছে, এটা একটা বড় অগ্রগতি। অতএব রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হবে, সময় লাগলেও হবে।
Publisher - Lutfur Rahman (Uzzal)
Published By The Editor From chttimes (Pvt.) Limited (Reg.No:-chttimes-83/2016)
Main Road,Gurosthan Mosque Market, Infront of district food Storage, Bandarban hill district,Bandarban.
Phone - News - 01673718271 Ad - 01876045846
Copyright © 2024 Chttimes.com. All rights reserved.