বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, ডাকনাম রেণু; আমাদের প্রিয় বঙ্গমাতা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনীর চেয়েও তাঁর বড় পরিচয় তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণাদায়ী। বাংলার মানুষের অধিকার রক্ষার সংগ্রামে আজীবন পাকিস্তানি শোষকশ্রেণীর জেল-জুলুম সহ্য করেছেন বঙ্গবন্ধু। আর তাঁর অনুপস্থিতিতে দলের কর্মীদের দেখভাল করার ভার সামলেছেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধু অন্তরীন থাকাকালীন দলের নেতাকর্মীদের মনোবল রক্ষায় গৃহকোণ থেকে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। জেলবন্দি বঙ্গবন্ধুর কাছে জরুরি খবর পৌঁছে দিতে, কর্মীদের কাছে নেতার নির্দেশনা পৌঁছে দিতে বঙ্গমাতাই ছিলেন ভরসার জায়গা। ৮ই আগস্ট এই মহীয়সী নারীর জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর লেখায় উঠে আসা বঙ্গমাতাকে নিয়ে বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে সাজানো এই সংকলন।
বন্ধুবান্ধবরা বলে, “তোমার জীবনী লেখ”। সহকর্মীরা বলে, “রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলি লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, “বসেই তো আছ, লিখো তোমার জীবনের কাহিনী।” বললাম, “লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি। একদিন সন্ধ্যায় বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিয়ে জমাদার সাহেব চলে গেলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট্ট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তার সাথে আমার পরিচয় হল। কেমন করে তার সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম। কিভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তাঁর স্নেহ আমি পেয়েছিলাম।
হঠাৎ মনে হল লিখতে ভাল না পারলেও ঘটনা যতদূর মনে আছে লিখে রাখতে আপত্তি কি? সময় তো কিছু কাটবে। বই ও কাগজ পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে চোখ দুইটাও ব্যথা হয়ে যায়। তাই খাতাটা নিয়ে লেখা শুরু করলাম। আমার অনেক কিছুই মনে আছে। স্মরণশক্তিও কিছুটা আছে। দিন তারিখ সামান্য এদিক ওদিক হতে পারে, তবে ঘটনাগুলি ঠিক হবে বলে আশা করি। আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু আমাকে কয়কটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।
একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, “তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।”
রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয়। রেণুর বড়বোনেরও আমার আর এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিবাহ হয়। এরা আমার শ্বশুরবাড়িতে থাকল, কারণ আমার ও রেণুর বাড়ির দরকার নাই। রেণুদের ঘর আমাদের ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান। অন্যান্য ঘটনা আমার জীবনের ঘটনার মধ্যেই পাওয়া যাবে।
সূত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী
পৃষ্ঠা- ৭-৮
আমি কলকাতা এসেই খবর পেলাম আমাদের দিল্লি যেতে হবে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সম্মেলনে যোগদান করতে। তোড়জোড় পরে গেলো। যারা যাবেন নিজের টাকায়ই যেতে হবে। আমি ও ইসলামিয়া কলেজ ইউনিয়ন সেক্রেটারি মীর আশরাফউদ্দিন ঠিক করলাম আমরাও যাব আমাদের নিজেদের টাকায়। আমাদের পূর্বেই ডেলিগেট করা হয়েছিলো। মীর আশরাফউদ্দিন ওয়ফে মাখন আমার খালাতো বোনের ছেলে। শহীদ সাহেবকে বললাম, “আমরা দিল্লি কনফারেন্সে যোগদান করবো।“ তিনি বললেন, “খুব ভাল, দেখতে পারবে সমস্ত ভারতবর্ষের মুসলমান নেতাদের।“ আমরা দুইজন ট্রেনে রওয়ানা দিলাম। দুই মামু-ভাগ্নের যা খরচ লাগবে দিল্লিতে তা কোনমতে বন্দোবস্ত করে নিলাম। টাকার বেশি প্রয়োজন হলে বোনের কাছ থেকে নিতাম, বোন আব্বার কাছ থেকে নিত। আব্বা বলে দিয়েছেন তাকে, আমার দরকার হলে টাকা দিতে। আব্বা ছাড়াও মায়ের কাছ থেকে আমি টাকা নিতে পারতাম। আর সময় সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোনদিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামের বাড়িতে থাকত, আমার জন্যই রাখত।
সূত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী
পৃষ্ঠাঃ ২৪-২৫
সালঃ ১৯৪৩
জেলে আমরা বিকালে ভলিবল খেলতাম। একদিন আমার হাতের কব্জি সরে গিয়েছিল, পড়ে যেয়ে। ভীষণ যন্ত্রণা, সহ্য করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। আমাকে বোধহয় মেডিকেল কলেজে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছিল। একজন নতুন ডাক্তার ছিল জেলে। আমার হাতটা ঠিকমত বসিয়ে দিল। ব্যথা সাথে সাথে কম হয়ে গেল। আর যাওয়া লাগল না। বাড়িতে আমার আব্বা ও মা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। রেণু তখন হাচিনাকে নিয়ে বাড়িতেই থাকে। হাচিনা তখন একটু হাঁটতে শিখছে। রেণুর চিঠি জেলেই পেয়েছিলাম। কিছু টাকাও আব্বা পাঠিয়ে ছিলেন। রেণু জানত, আমি সিগারেট খাই। টাকা পয়সা নাও থাকতে পারে, টাকার দরকার হলে লিখতে বলেছিল।
সূত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী
পৃষ্ঠাঃ ১১৮
সালঃ ১৯৪৯
আমি কয়েকদিন বাড়িতে ছিলাম। আব্বা খুবই দুঃখ পেয়েছেন। আমি আইন পড়ব না শুনে বললেন, “যদি ঢাকায় না পড়তে চাও, তবে বিলেত যাও। সেখান থেকে বার এট ল’ ডিগ্রি নিয়ে এস। যদি দরকার হয় আমি জমি বিক্রি করে তোমাকে টাকা দিবো।“ আমি বললাম, “এখন বিলেতে গিয়ে কি হবে, অর্থ উপার্জন করতে আমি পারব না।“ আমার ভীষণ জেদ হয়েছে মুসলিম লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। যে পকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, এখন দেখি তার উল্টা হয়েছে। এর একটা পরিবর্তন করা দরকার। জনগণ আমাদের জানত এবং আমাদের কাছেই প্রশ্ন করত। স্বাধীন হয়েছে দেশ, তবু মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর হবে না কেন? দুনীতি বেড়ে গেছে, খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। বিনা বিচারে রাজনৈতিক কর্মীদের জেলে বন্ধ করে রাখা হচ্ছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মুসলিম লীগ নেতারা মানবে না। পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প কারখানা গড়া শুরু হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না। রাজধানী করাচি। সব কিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব বাংলায় কিছু নাই। আব্বাকে সকল কিছুই বললাম। আব্বা বললেন, “আমাদের জন্য কিছু করতে হবে না। তুমি বিবাহ করেছ, তোমার মেয়ে হয়েছে, তাদের জন্য তো কিছু একটা করা দরকার।“ আমি আব্বাকে বললাম, “আপনি তো আমাদের জন্য জমিজমা যথেষ্ট করেছেন, যদি কিছু না করতে পারি, বাড়ি চলে আসব। তবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া চলতে পারে না। আমাকে আর কিছু বললেন না। রেণু বলল, “এভাবে তোমার কতকাল চলবে।” আমি বুঝতে পারলাম, যখন আমি ওর কাছে এলাম। রেণু আড়াল থেকে সব কথা শুনছিল। রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্যে টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয়। আমি ঢাকায় রওয়ানা হয়ে আসলাম। রেণুর শরীর খুব খারাপ দেখে এসেছিলাম।
সূত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী
পৃষ্ঠাঃ ১২৬
সালঃ ১৯৪৯
বাড়িতে পৌঁছালাম, কেউ ভাবতেও পারে নাই আমি আসব। সকলেই খুব খুশি। মেয়েটা তো কোল থেকে নামতেই চায় না, আর ঘুমাতেও চায় না। আব্বাকে বললাম সকল কথা। বাড়িতে পাহারা রাখলাম। বৈঠকখানায় রাতভর লোক জেগে থাকবে, যদি কেউ আসে আমাকে খবর দেবে। আমাদের বাড়ি অনেক বড় এবং অনেক লোক। এখন গ্রেফতার হতে আমার বেশি আপত্তি নাই। তবে ঢাকা যাওয়া দরকার একবার। বেশি দিন যে বাড়ি থাকা চলবে না, তা আব্বা ও রেণুকে বুঝিয়ে বললাম । বোধহয় সাত-আট দিন বাড়িতে রইলাম। বললাম, “বরিশাল হয়ে জাহাজ যায়, এ পথে যাওয়া যাবে না; আর গোপালগঞ্জ হয়েও যাওয়া সম্ভবপর নয় । পথে গ্রেফতার করে ফেলতে পারে। আমি গোপালগঞ্জের দুই ঘাট পরে জাহাজে উঠব। তারপর কবিরাজপুর থেকে নৌকায় মাদারীপুর মহকুমার শিবচর থেকে জাহাজে উঠব। দু’একদিন আমার বড়বোনের বাড়িতে বেড়িয়ে যাব।” বড়বোনের বাড়ি শিবচর থেকে মাত্র পাঁচ মাইল পথ। রেণু বলল, “কতদিন দেখা হবে না বলতে পারি না। আমিও তোমার সাথে বড়বোনের বাড়িতে যাব, সেখানেও তো দু’একদিন থাকবা। আমি ও ছেলেমেয়ে দুইটা তোমার সাথে থাকব। পরে আব্বা যেয়ে আমাকে নিয়ে আসবেন।” আমি রাজি হলাম, কারণ আমি তো জানি, এবার আমাকে বন্দি করলে সহজে ছাড়বে না। নৌকায় এতদূর যাওয়া কষ্টকর। আমরা বিদায় নিয়ে রওয়ানা করলাম। দুইজন কর্মীও আমার সাথে চলল। এরা কবিরাজপুর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল এবং রাতভর পাহারা দিয়েছিল। শীতের দিন ওরা এক কাপড়ে এসেছিল। রেণু নিজের গায়ের চাদর ওদের দিয়েছিল। আমরা বোনের বাড়িতে পৌঁছালাম, একদিন দুই দিন করে সাত দিন সেখানে রইলাম।
ছেলেমেয়েদের জন্য যেন একটু বেশি মায়া হয়ে উঠেছিল। ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবুও তো যেতে হবে। দেশ সেবায় নেমেছি, দয়া মায়া করে লাভ কি? দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে। আব্বা আমাকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। আর রেণুও কিছু টাকা নিয়ে এসেছিল আমাকে দিতে। আমি রেণুকে বললাম, “এতদিন একলা ছিলে, এখন আরও দু’জন তোমার দলে বেড়েছে। আমার দ্বারা তো কোনো আর্থিক সাহায্য পাবার আশা নাই। তোমাকেই চালাতে হবে। আব্বার কাছে তো সকল সময় তুমি চাইতে পার না, সে আমি জানি। আর আব্বাই বা কোথায় এত টাকা পাবেন? আমার টাকার বেশি দরকার নাই। শীঘ্রই গ্রেফতার করে ফেলবে। পালিয়ে বেড়াতে আমি পারব না। তোমাদের সাথে কবে আর দেখা হয় ঠিক নাই। ঢাকা এস না। ছেলেমেয়েদের কষ্ট হবে। মেজোবোনের বাসায়ও জায়গা খুব কম। কোনো আত্মীয়দের আমার জন্য কষ্ট হয়, তা আমি চাই না। চিঠি লিখ, আমিও লিখব। রাতে রওয়ানা করে এলাম। দিনেরবেলায় আসলে হাচিনা কাঁদবে। কামাল তো কিছু বোঝে না।
রেণু আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় নীরবে চোখের পানি ফেলছিলো। আমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম না, একটা চুমা দিয়ে বিদায় নিলাম। বলবার তো কিছুই আমার ছিলো না। সবই তো ওকে বলেছি।
সূত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী
পৃষ্ঠাঃ ১৬৪-১৬৫
সালঃ ১৯৫০
ফরিদপুর জেল থেকে গোপালগঞ্জ যেয়ে দেখি থানার ঘাটে আমাদের নৌকা। আব্বা, মা, রেণু, হাচিনা ও কামালকে নিয়ে হাজির। ঘাটেই দেখা হয়ে গেল। এরাও এইমাত্র বাড়ি থেকে এসে পৌঁছেছে। গোপালগঞ্জ থেকে আমার বাড়ি চৌদ্দ মাইল দূরে। এক বৎসর পরে আজ ওদের সাথে আমার দেখা। হাচিনা আমার গলা ধরল আর ছাড়তে চায় না। কামাল আমার দিকে চেয়ে আছে, আমাকে চেনে না আর বুঝতে পারে না, আমি কে? মা কাঁদতে লাগল। আব্বা মাকে ধমক দিলেন এবং কাদতে নিষেধ করলেন। আমি থানায় আসলাম, বাড়ির সকলে আমাদের গোপালগঞ্জের বাসায় উঠল। থানায় যেয়ে দেখি এক দারোগা সাহেব বদলি হয়ে গেছেন, তার বাড়িটা খালি আছে। আমাকে থাকবার অনুমতি দিল সেই বাড়িতে। তাড়াতাড়ি কোর্টে যেতে হবে। প্রস্তুত হয়ে কোর্টে রওনা করলাম, এবার রাস্তায় অনেক ভিড়। বহু গ্রাম থেকেও অনেক সহকর্মী ও সমর্থক আমাকে দেখতে এসেছে। কোর্টে হাজির হলাম, হাকিম সাহেব বেশি দেরি না করে সাক্ষ্য নিতে শুরু করলেন। পরের দিন আবার তারিখ রাখলেন। আমি আমার আইনজীবীকে বললাম অনুমতি নিতে, যাতে আমার মা, আব্বা, ছেলেমেয়েরা আমার সাথে থানায় সাক্ষাৎ করতে পারেন। তিনি অনুমতি দিলেন। থানায় ফিরে এলাম এবং দারোগা সাহেবের বাড়িতেই আমার মালপত্র রাখা হল। আব্বা, মা, রেণু খবর পেয়ে সেখানেই আসলেন। আব্বা, মা ও ছেলেমেয়েরা কেয়েক ঘন্টা রইলো। কামাল কিছুতেই আমার কাছে আসলো না। দূর থেকে চেয়ে থাকে। ও বোধহয় ভাবত, এ লোকটা কে?
সূত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী
পৃষ্ঠাঃ ১৮৩-১৮৪
সালঃ ১৯৫০
আমি গোপালগঞ্জে আসলাম, মামলা চলছিল। বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এসেছে। বললাম কিছু ডিম কিনে দিতে, কারণ না খেয়ে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। এক মাসে শরীর আমার একদম ভেঙে গিয়েছে। চোখের অবস্থা খারাপ। পেটের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। বুকে ব্যথা অনুভব করতে শুরু করেছি। রেণু আমাকে সাবধান করল এবং বলল, “ভুলে যেও না, তুমি হার্টের অসুখে ভুগেছিলে এবং চক্ষু অপারেশন হয়েছিল।” ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, আর কি করা যায়। হাচু আমাকে মোটেই ছাড়তে চায় না। আজকাল বিদায় নেওয়ার সময় কাদতে শুরু করে। কামালও আমার কাছে এখন আসে। হাচু ‘আব্বা বলে ডাকে কামালও আব্বা বলতে শুরু করেছে। গোপালগঞ্জ থানা এলাকার মধ্যে থাকতে পারি বলে কয়েক ঘণ্টা ওদের সাথে থাকতে সুযোগ পেতাম।
সূত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী
পৃষ্ঠাঃ ১৮৫
সালঃ ১৯৫০
রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, “জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন, আমার কেউই নাই। তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে?” কেঁদেই ফেলল। আমি রেণুকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তাতে ফল হল উল্টা। আরও কাদতে শুরু করল, হাচু ও কামাল ওদের মা’র কাদা দেখে ছুটে যেয়ে গলা ধরে আদর করতে লাগল। আমি বললাম, “খোদা যা করে তাই হবে, চিন্তা করে লাভ কি? পরের দিন ওদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মাকে বোঝাতে অনেক কষ্ট হল।
সূত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী
পৃষ্ঠাঃ ১৯১
সালঃ ১৯৫০
এক এক করে সকলে যখন আমার কামরা থেকে বিদায় নিল, তখন রেণু কেঁদে ফেলল এবং বলল, “তোমার চিঠি পেয়ে আমি বুঝেছিলাম, তুমি কিছু একটা করে ফেলবা। আমি তোমাকে দেখবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাকে বলব নিয়ে যেতে, আব্বাকে বলতে পারি না লজ্জায়। নাসের ভাই বাড়ি নাই। যখন খবর পেলাম খবরের কাগজে, তখন লজ্জা শরম ত্যাগ করে আব্বাকে বললাম। আব্বা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাই রওয়ানা করলাম ঢাকায়, সোজা আমাদের বড় নৌকায় তিনজন মাল্লা নিয়ে। কেন তুমি অনশন করতে গিয়েছিলে? এদের কি দয়া মায়া আছে? আমাদের কারও কথাও তোমার মনে ছিল না? কিছু একটা হলে কি উপায় হত? আমি এই দুইটা দুধের বাচ্চা নিয়ে কি করে বাঁচতাম? হাচিনা, কামালের অবস্থা কি হত? তুমি বলবা, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট তা হত না? মানুষ কি শুধু খাওয়া পরা নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়? আর মরে গেলে দেশের কাজই বা কিভাবে করতা?” আমি তাকে কিছুই বললাম না। তাকে বলতে দিলাম, কারণ মনের কথা প্রকাশ করতে পারলে ব্যথাটা কিছু কমে যায়। রেণু খুব চাপা, আজ যেন কথার বাঁধ ভেঙে গেছে। শুধু বললাম, “উপায় ছিল না। বাচ্চা দুইটা ঘুমিয়ে পড়েছে। শুয়ে পড়লাম। সাতাশ-আঠাশ মাস পরে আমার সেই পুরানা জায়গায়, পুরানা কামরায়, পুরানা বিছানায় শুয়ে কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠের দিনগুলির কথা মনে পড়ল।
সূত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী
পৃষ্ঠাঃ ২০৭
সালঃ ১৯৫২ (২১শে ফেব্রুয়ারির পর জেলে অনশনরত অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফেরার পর শেখ মুজিবের সাথে বঙ্গমাতার কথপোকথন)
একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘ আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, “হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।” আমি আর রেণু দু’জনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ” আমি তো তোমারো আব্বা।” কামাল আমার কাছে আসতে চাইতো না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায় !আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস।
সূত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী
পৃষ্ঠাঃ ২০৯
সালঃ ১৯৫২
আগস্ট মাসের শেষের দিকে বরিশাল হয়ে বাড়ি যেতে হল, টাকা পয়সার খুব অভাব হয়ে পড়েছে। কিছুদিন বাড়িতে থাকলাম, তারপর ঢাকায় ফিরে এলাম। ল’ পড়া ছেড়ে দিয়েছি। আব্বা খুবই অসন্তুষ্ট, টাকা পয়সা দিতে চান না। আমার কিছু একটা করা দরকার। ছেলেমেয়ে হয়েছে, এভাবে কতদিন চলবে! রেণু কিছুই বলে না, নীরবে কষ্ট সহ্য করে চলেছে। আমি বাড়ি গেলেই কিছু টাকা লাগবে তাই জোগাড় করার চেষ্টায় থাকত। শেষ পর্যন্ত আব্বা আমাকে টাকা দিলেন, খুব বেশি টাকা দিতে পারেন নাই, তবে আমার চলবার মত টাকা দিতে কোনোদিন আপত্তি করেন নাই। আমার নিজের বেশি কোনো খরচ ছিল না, একমাত্র সিগারেটই বাজে খরচ বলা যেতে পারে। আমার ছোট ভাই নাসের খুলনায়। সে আমার ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করে। বাড়ি থেকে তার কোনো টাকা পয়সা নিতে হয় না। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে কিছু টাকা বাড়িতে দিতেও শুরু করেছে।
সূত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী
পৃষ্ঠাঃ ২২১
সালঃ ১৯৫২
আমি সন্ধ্যার দিকে ঢাকায় ফিরে এলাম। বাসায় যেয়ে দেখি রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে গতকাল ঢাকায় এসেছে। সে এখন ঢাকাতেই থাকবে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বন্দোবস্ত হওয়া দরকার। আমি খুশি হলাম, আমি তো মোসাফিরের মত থাকি। সে এসে সকল কিছু ঠিকঠাক করতে শুরু করেছে। আমার অবস্থা জানে, তাই বাড়ি থেকে কিছু টাকাও নিয়ে এসেছে।
সূত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী
পৃষ্ঠাঃ ২৬২
সালঃ ১৯৫৪
শপথ নেওয়ার পরে পাঁচ মিনিটের জন্য বাড়িতে আসতে পারি নাই। আর দিনভর কিছু পেটেও পড়ে নাই। দেখি রেণু চুপটি করে না খেয়ে বসে আছে, আমার জন্য।
সূত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী
পৃষ্ঠাঃ ২৬২
সালঃ ১৯৫৪(যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী হয়ে শপথ নেয়ার দিনের ঘটনা)
বাসায় এসে দেখলাম, রেণু এখনও ভাল করে সংসার পাততে পারে নাই। তাকে বললাম, “আর বোধহয় দরকার হবে না। কারণ মন্ত্রিত্ব ভেঙে দিবে, আর আমাকেও গ্রেফতার করবে। ঢাকায় কোথায় থাকবা, বোধহয় বাড়িই চলে যেতে হবে। আমার কাছে থাকবা বলে এসেছিলা, ঢাকায় ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ হবে, তা বোধহয় হল না। নিজের হাতের টাকা পয়সাগুলিও খরচ করে ফেলেছি।” রেণু ভাবতে লাগল, আমি গোসল করে ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম করছিলাম। বেলা তিনটায় টেলিফোন এলো, কেন্দ্রীয় সরকার ৯২(ক) ধারা জারি করেছে। মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করা হয়েছে।
আমি তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে আওয়ামী লীগ অফিসে যেয়ে দরকারি কাগজপত্র সরিয়ে বের হওয়ার সাথে সাথে অন্য পথ দিয়ে পুলিশ অফিসে এসে পাহারা দিতে আরম্ভ করল। আমি আবার নান্না মিয়ার বাড়িতে উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে আমাকে জানাল, বড় বড় পুলিশ কর্মচারীরা আমাকে খুঁজতে এসেছিল। বাড়িতে ফোন করে জানলাম সেখানেও গিয়েছিল। আমি রেণুকে বললাম, “আবার আসলে বলে দিও শীঘ্র আমি বাড়িতে পৌঁছাব।”
আমি সরকারি গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রিকশা ভাড়া করে বাড়ির দিকে রওয়ানা করলাম। দেখলাম, কিছু কিছু পুলিশ কর্মচারী আমার বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। আমি রিকশায় পৌছালাম, তারা বুঝতে পারে নাই। রেণু আমাকে খেতে বলল, খাবার খেয়ে কাপড় বিছানা প্রস্তুত করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব চৌধুরীকে ফোন করে বললাম, আমার বাড়িতে পুলিশ এসেছিল, বোধহয় আমাকে গ্রেফতার করার জন্য। আমি এখন ঘরেই আছি গাড়ি পাঠিয়ে দেন। তিনি বললেন, ‘আমরা তো হুকুমের চাকর। গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনি প্রস্তুত হয়ে থাকুন। আপনাকে গ্রেফতার করার জন্য বারবার টেলিফোন আসছে। আমি তাঁকে ধনাবাদ দিয়ে ফোন ছেড়ে দিলাম। রেণু আমার সকল কিছু ঠিক করে দিল এবং কাদতে লাগল। ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওদের ওঠাতে নিষেধ করলাম। রেণুকে বললাম, তোমাকে কি বলে যাব, যা ভাল বোঝো কর, তবে ঢাকায় থাকলে কষ্ট হবে, তার চেয়ে বাড়ি চলে যাও।
বন্ধু ইয়ার মোহাম্মাদ খানকে বলে গিয়েছিলাম, যদি রেণু বাড়ি না যায় তা হলে একটা বাড়ি ভাড়া করে দিতে। ইয়ার মোহাম্মাদ খান ও আল হেলাল হোটেলের মালিক হাজী হেলাল উদ্দিন রেণুকে বাড়ি ভাড়া করে দিয়েছিলো এবং তখন দেখাশোনাও করেছিলো।
সূত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী
পৃষ্ঠাঃ ২৭১-১৭২(পিডিএফ ২৮৭)
সালঃ ১৯৫৪(যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী সভা ভেঙ্গে দিয়ে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার)