প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার (১০ জানুয়ারি) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালন উপলক্ষে রবিবার (৯ জানুয়ারি) দেওয়া এক বাণীতে বলেন, ‘‘জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের এই মাহেন্দ্রক্ষণে আসুন, আমরা প্রতিজ্ঞা করি—৩০ লাখ শহীদ ও দু’লাখ নির্যাতিত মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখবো। সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে কার্যকর ভূমিকা রাখবো।’’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে এক কালজয়ী মহাপুরুষ, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের এই দিনে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে ফিরে পায়। মহান নেতার আগমনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের আনন্দ পরিপূর্ণতা লাভ করে।’
তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য দীর্ঘ ২৪ বছর সংগ্রাম করেছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম সকল ক্ষেত্রেই তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, সব সময় দূরদর্শী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এবং ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে দলকে সুসংগঠিত করেছেন। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পূর্ব বাংলার জনগণের এ রায়কে উপেক্ষা করে শুরু করে প্রহসন। বাংলার নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে জাতির পিতা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের এক জনসমুদ্রে ঘোষণা করেন— ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি নিধন শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।’’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরপরই পাকিস্তানি বাহিনী জাতির পিতাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের নির্জন কারাগারে প্রেরণ করে এবং তাঁর ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাতে থাকে। তিনি ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের সামরিক আদালতে প্রহসনের বিচারে ফাঁসির আসামি হিসেবে মৃত্যুর প্রহর গুনতে গুনতেও তিনি বাঙালির জয়গান গেয়েছেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণশক্তি। তাঁর অবিচল নেতৃত্বে বাঙালি জাতি মরণপণ যুদ্ধ করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে। পরাজিত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারির প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। একই দিন তিনি লন্ডনে অবতরণ করেন। সেখানে কমনওয়েলথ মহাসচিবের আহ্বানে বাংলাদেশের সদস্যপদ গ্রহণে তাৎক্ষণিক সম্মতি জানান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং সংবাদ সম্মেলন করেন। জাতির পিতা ১০ জানুয়ারি সকালে দিল্লিতে যাত্রাবিরতি দিয়ে দুপুরে তাঁর প্রিয় মাতৃভূমিতে পদার্পণ করেন। ওই দিন রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রে এক ভাষণে তিনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ভয়াবহ ও নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দেন। সেই সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা সংগঠনের দায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বিচারের মুখোমুখি করতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান।’’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর বলিষ্ঠ পদক্ষেপে ভারতীয় মিত্রবাহিনী ১৫ মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। তিনি একই বছর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে সই করেন। জাতির পিতার সফল দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক তৎপরতায় বাংলাদেশ বিশ্বের ১২৩টি দেশ এবং ১৬টি আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃতি লাভ করে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে মাত্র সাড়ে তিন বছরেই স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী চক্র জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে দেশে হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চালু করে। তারা ’৭৫-এর ২৬ সেপ্টেম্বর দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয়। মোস্তাক-জিয়া চক্র খুনিদের বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে কূটনীতিকের চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে, রাজনৈতিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত করে। মার্শাল ল’ জারির মাধ্যমে গণতন্ত্র হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে বিকৃত করে। সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করে। বিএনপি-জামাত সরকার এই ধারা অব্যাহত রাখে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘২১ বছরের দীর্ঘ সংগ্রাম ও অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। আমরা একই বছর ১২ নভেম্বর ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল আইন, ১৯৯৬’ প্রণয়ন করে জাতির পিতা হত্যার বিচার কার্যক্রম শুরু করি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড পুস্তকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরি। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে ‘দিনবদলের সনদ’ ঘোষণা দিয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করি এবং পরপর তিন দফা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করি। আমরা জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছি। ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছি। সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করেছি, ফলে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পথ বন্ধ হয়েছে।’’
তিনি বলেন, ‘গত ১৩ বছরে আমরা উন্নয়নের সব সূচকে অভূতপূর্ব অগ্রগতি করেছি। অর্থনৈতিক অগ্রগতির মানদণ্ডে বিশ্বের প্রথম ৫টি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছি। আমাদের সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে এবং ‘এসডিজি প্রোগ্রেস অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছে। আমরা দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছি। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৫৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত করেছি। প্রায় শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধা দিচ্ছি। চলমান করোনা মহামারি থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে ২৮টি প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছি। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেস ওয়ে এবং কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশ যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এক নবযুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। আমরা সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আধুনিক করেছি। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি। ‘রূপকল্প-২০২১’ অর্জন করেছি, দেশকে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত করেছি। মুজিববর্ষে আমরা অঙ্গীকার করেছি কেউ গৃহহীন থাকবে না। শহরের সব সুযোগ-সুবিধা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও পৌঁছে দিচ্ছি। ২০৩০ সালের মধ্যে ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট’ অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে ‘দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা’ বাস্তবায়ন শুরু করেছি। ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ নামে একটি যুগান্তকারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। নানা প্রতিবন্ধকতা জয় করে আমরা বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।’’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। ২০২১ সালের মার্চে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করি, যেখানে সার্কভুক্ত ৫টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানগণ সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানমালায় যোগ দিয়েছিলেন। তাছাড়া বিশ্বের ৭৭টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানগণ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানরা ভিডিও বার্তা ও অভিনন্দনপত্র প্রেরণ করেছেন। আমাদের সরকারের উদ্যোগে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের রাজধানী এবং গুরুত্বপূর্ণ শহরে জাতির পিতার নামে স্মারক ভাস্কর্য স্থাপন, সড়ক ও পার্কের নামকরণ করা হয়েছে। ইউনেস্কো জাতির পিতার ‘৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ’কে বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের অংশ হিসেবে সৃজনশীল অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তন করেছে।’’
প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গৃহীত সব কর্মসূচির সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করেন। খবর: বাসস