॥ ‘রমিজ শেখ, কান্দুনী বালা, ভবেশ গুনজারসহ শ’ শ’ দিনহীন, ভূমিহীন, গৃহহীন মানুষ। নামের মতোই বেদনার্ত তাদের জীবন। কারও নেই নিজস্ব কোন স্থায়ী ঠিকানা। সবার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। মাঠে-ঘাটে কাজ করে যা পায়, তাই দিয়ে টেনেটুনে চলে তাদের জোড়াতালির সংসার। দুই-তিন দশক ধরেই সরকারী খাস জমি কিংবা পরের পরিত্যক্ত জমিতে ভাসমান হয়ে কোনভাবে মাথা গুঁজে দিন কাটে তাদের। তার ওপর যখন তখন উচ্ছেদের ভয়। হাত পেতে কিংবা স্বল্প টাকায় মাঠে-ঘাটে কাজ করে নিজের সংসার চালানোই দায়। সেখানে একখণ্ড জমি কিনে সেখানে বাড়ি করা- তা যেন ‘মাটিতে থেকে চাঁদ ছোঁয়া’র মতো অলিক কল্পনা, স্বপ্নাতীত। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে অনেকটাই দূর হচ্ছে তাদের আক্ষেপ। কারণ মাত্র ক’দিন পরই পাচ্ছেন নিজস্ব স্বপ্ননীড়, নিজস্ব ঠিকানা। সবার সামনে এখন বিনামূল্যে দুই শতাংশ ভূমি মালিকানাসহ পাকা বাড়ি পাওয়ার স্বপ্ন। এমন প্রাপ্তির আনন্দ-উচ্ছ্বাস এখন দিনহীন লাখো মানুষের চোখে-মুখে। গৃহহীনরা তাদের স্বপ্নের পূর্ণতা পাওয়ার অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
এটি কোন গল্প বা স্বপ্ন নয়। এটা হচ্ছে বাংলাদেশের সম্পূর্ণ বাস্তবতার চিত্র। পৃথিবীর অর্থনৈতিক বড় ধনী দেশগুলো যেটি এতদিন করতে পারেনি, সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন, তিনি আর কেউ নন। তিনি হচ্ছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুজিববর্ষে এমনি প্রায় পৌনে দুই লাখ ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারী খরচে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে উপহার দিচ্ছেন ‘স্বপ্নের নীড়’, দুই শতক জমির মালিকানাসহ সুদৃশ্য রঙিন টিনশেডের পাকা বাড়ির স্থায়ী ঠিকানা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন- দেশের একটি মানুষও গৃহহীন বা ভূমিহীন থাকবে না। তার এই মহান ব্রতকে সামনে রেখেই মুজিববর্ষে প্রতিটি গৃহহীন-ভূমিহীন পরিবারই পাচ্ছেন একক ঘর, আর দুই শতাংশ জমির মালিকানা। তাও আবার বিনামূল্যে। মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী দেশের ঠিকানাহীন এসব অসহায় সব মানুষকে সরকারী খরচে করে দিচ্ছেন একটি করে স্থায়ী ঠিকানা। যা বিশ্বেও নজিরবিহীন। উন্নত বিশ্বও তাদের ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারগুলোকে সরকারী খরচে জমিসহ বাড়ি নির্মাণ করার এমন একটি দৃষ্টান্ত দেখাতে পারেনি। যা পেরেছে একসাগর রক্তের মাধ্যমে অর্জিত বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন লাখও অসহায় মানুষকে দিচ্ছেন তার সেরা উপহার।
এ মাসেই ভূমিহীন-গৃহহীনদের মাঝে দুই শতক জমির মালিকানাসহ প্রায় ৭০টি তৈরি ঘর উপহার হিসেবে তাদের কাছে হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর চলতি বছর অর্থাৎ মুজিববর্ষেই আরও ৮ লাখেরও বেশি ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে স্বপ্নের নীড়সহ দুই শতক জমির মালিকানা দিয়ে স্থায়ী ঠিকানা গড়ে দেবেন সরকারীভাবে। বাস্তুহারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘মানবতার মা’ উপাধি পেয়েছিলেন। আর এবার দেশের বিপুলসংখ্যক ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে নিজস্ব ঠিকানা অর্থাৎ জমির মালিকানাসহ সরকারী খরচে নির্মিত বাড়ি নির্মাণ করে দেয়ার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের সামনে আরেকটি মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডাঃ এনামুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবেন না। এমন ব্রত নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছি। গৃহহীনকে ঘরে করে দেয়ার কয়েকটি প্রকল্পের মধ্যে এটি একটি প্রকল্প, যা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী চান দেশে কোন মানুষ গৃহহীন থাকবে না। সবার মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে। তিনি জানান, ইতোমধ্যে দেশে ৮ লাখ ৮২ হাজার ৩৩ গৃহহীন-ভূমিহীন পরিবারের তালিকা করা হয়েছে। মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মধ্যেই তাদের সবাইকে সরকারীভাবে ঘর নির্মাণ করে দেয়া হবে। আর প্রথম ধাপে ‘ক’ তালিকাভুক্ত ভূমিহীন-গৃহহীনদের জন্য প্রায় ৭০ হাজার নতুন ঘর নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী ২০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন শেষে বাড়িগুলো হস্তান্তর করবেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন অনুযায়ী সবাই পাবেন একটি করে স্বপ্ননীড়।
‘আশ্রায়নের অধিকার শেখ হাসিনার উপহার’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে মুজিব শতবর্ষে দেশেই নির্মিত হচ্ছে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য এই ‘স্বপ্নের নীড়’। স্বাধীনতার গত ৪৯ বছরে যাদের ছিল না কোন স্থায়ী ঠিকানা, একখণ্ড জমি কিংবা নিজস্ব বাড়ি। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর স্বপ্ন পূরণে সব ভূমিহীন-গৃহহীনদের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে দুই শতক জমির ওপর পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে দেশে প্রথম পর্যায়ে প্রায় ৭০ হাজার গৃহহীনদের মাঝে দুই শতক জমিসহ নির্মিত বাড়িগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে এ মাসেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হস্তান্তর করবেন বলে জানা গেছে।
বিনামূল্যে শুধু স্থায়ী ঠিকানাই নয়, নির্মিত বাড়িগুলোও বেশ উন্নতমানের। প্রতিটি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবার পাবেন বাড়িসহ দুই শতক জমির মালিকানা। সেমিপাকা প্রতিটি বাড়িতে থাকছে দুইটা বেডরুম, একটা কিচেন রুম, একটা ইউটিলিটি রুম, একটা টয়লেট ও একটা বারান্দা। ইটের দেয়াল, কংক্রিটের মেঝে এবং রঙিন টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি দুইটি কক্ষের আবাসন। ঘরগুলো যাতে টেকসই হয় সেজন্য ভূমিকম্পরোধক ব্যবস্থাও থাকছে। সারাদেশে গৃহহীনদের জন্য গৃহ নির্মাণের এই মহাযজ্ঞ প্রতিনিয়ত মনিটরিং করছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া সাংবাদিকদের জানান, পৃথিবীতে এমন নজির আর কোথাও নেই। সম্পূর্ণ সরকারী খরচে বিপুলসংখ্যক ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে জমির মালিকানাসহ পাকা বাড়ি নির্মাণ করে একটি স্থায়ী ঠিকানা দেয়ার নজির বিশ্বে আর কোথাও নেই। আর সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে মুজিববর্ষে বিশ্বে আরেকটি মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুজিববর্ষে ভূমিহীন-গৃহহীন প্রতিটি পরিবারই পাচ্ছে একক ঘর, আর দুই শতাংশ জমির মালিকানা। এখানে বিপুলসংখ্যক এসব অসহায় মানুষ শুধু পুনর্বাসিতই হবেন না, দেশের দারিদ্র্যবিমোচনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
গত ৭ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি ও তৃতীয় বর্ষে পদার্পণের দিনে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী পুনর্বার ঘোষণা দেন, দেশের একটি মানুষও গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না। আমরা প্রতিটি গৃহহীন পরিবারকে সরকারীভাবে গৃহ নির্মাণ করে দেব, ভূমিহীনদের স্থায়ী ঠিকানা দেব। সরকার এই নীতি নিয়ে দেশ পরিচালনা করছে। ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য প্রত্যেককে দুই শতাংশ খাসজমি বরাদ্দসহ ৬৫ হাজার ৭২৬টি ঘর তৈরির কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যও ১৪ হাজার গৃহ নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে। মুজিববর্ষে দেশের শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দিয়ে গোটা দেশকে আলোকিত করারও ঘোষণা দেন তার ভাষণে।
সূত্র জানায়, বিদায়ী ২০২০ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, মুজিববর্ষে দেশে কোন মানুষ গৃহহীন থাকবে না। সরকার সব ভূমিহীন, গৃহহীন মানুষকে ঘর তৈরি করে দেবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই ঘোষণা বাস্তবায়নে দেশে নির্দেশনা পাঠানো হয়। সেই অনুযায়ী শুরু হয় দেশের প্রতিটি অঞ্চলে গৃহহীন-ভূমিহীনদের তালিকা তৈরি করে বাড়ি নির্মাণের মহাযজ্ঞ। চলমান মুজিববর্ষের মধ্যেই এসব ঘর নির্মাণ কাজ শেষ করতে চায় সরকার।
জানা গেছে, সরকারের তিনটি কর্মসূচীর আওতায় দেশের ভূমিহীন ঠিকানাহীন মানুষদের ঘর তৈরি দেয়ার কাজ করছে। এসব কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের আওতায় দুর্যোগ সহনীয় বাড়ি প্রকল্প। ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২। এর বাইরে আমার বাড়ি, আমার খামার প্রকল্পও রয়েছে। সরকরের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা যৌথভাবে গৃহহীনদের জন্য নেয়া এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
সূত্র জানায়, অনেক আগে থেকেই এই তিনটি প্রকল্পের মাধ্যমে নদী ভাঙ্গন পরিবার, বেদে পরিবার ও হিজড়াসহ বিভিন্ন কারণে যারা ভূমিহীন ও গৃহহীন হয়েছেন, তাদের ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই এসব প্রকল্পের অনেক বাড়িঘর সংশ্লিষ্টদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রায় আড়াই লাখ টাকা ব্যয়ে প্রায় ১৭ হাজার দুর্যোগ সহনীয় ঘরগুলো গত ১৩ অক্টোবর আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবসে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশিকা অনুসরণ করে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টরা সুবিধাভোগীদের নির্বাচন করেছেন। কারও এক বা দুই শতাংশ জায়গা আছে কিন্তু ঘর নেই বা ঘর আছে কিন্তু তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে, তাদের এই ঘর দেয়া হচ্ছে। তবে মুজিববর্ষ উপলক্ষে যে প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে তা আলাদাভাবে বাস্তবায়ন করা হলেও ঘরের নক্সা একই হবে। তবে দেশের বিভাগীয় সদর ও জেলা শহরে স্থায়ী ভূমিহীন বাসিন্দারা এ প্রকল্পে কর্মসূচীর আওতায় সরকারের দেয়া ঘর পাবেন না। ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে ভূমিহীন পরিবার রয়েছে পৌনে তিন লাখের মতো। এসব ভূমিহীন পরিবার এই ঘরগুলো পাবেন।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শহরে বা শহরের কাছাকাছি সুবিধা মতো জায়গায় যেখানে খাস জমি নেই, সেখানে বহুতল ভবন করে ফ্ল্যাটের মাধ্যমে পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করা হবে। আর শহরের বাইরে যারা আছেন তাদের প্রত্যেককেই বাড়ি করে দেয়া হবে। ভূমিহীনদের পরিবারকে দুই শতাংশ জায়গার ওপর দুটি শোবার ঘর, একটি বারান্দা, একটি রান্নাঘর ও একটি বাথরুম সংবলিত ঘর করে দেয়া হচ্ছে। আর যাদের জায়গা আছে, ঘর নেই তাদেরও একই ধরনের ঘর তৈরি করে দেয়া হবে। তবে কোন এলাকায় খাসজমি পাওয়া না গেলে সেখানে প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করে জেলা প্রশাসক এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবেন।