বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের এই পরিসংখ্যান ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য রীতিমতো উদ্বেগের।
খুবই ‘গুরুতর’ পরিস্থিতি ভারতের জন্য। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত বিশ্বের ১০৭টি দেশের মধ্যে ৯৪ নম্বরের দেশ। প্রতিবেশি দেশগুলির প্রায় সবাই তালিকায় ভারতের আগে রয়েছে। ভারতের তুলনায় তাদের অবস্থা ভালো। বাংলাদেশ রয়েছে ৭৫ নম্বরে। মিয়ানমার রয়েছে ৭৮ নম্বরে এবং পাকিস্তান রয়েছে ৮৮ নম্বরে। অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের মধ্যে নেপাল আছে ৭৩ নম্বরে। শ্রীলংকা আছে ৬৪ নম্বরে।
১০৭টি দেশের মধ্যে ভারতের পেছনে রয়েছে আফগানিস্তান, রুয়ান্ডা, নাইজেরিয়া, লাইবেরিয়া, মোজাম্বিক, চাদের মতো অনুন্নত দেশগুলি। এই ইনডেক্স প্রকাশের পরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী।
টুইটে রাহুল লিখেছেন, ‘ভারতের গরিব মানুষেরা ক্ষুধার্ত। কারণ, সরকার শুধু নিজের কিছু ‘মিত্র’র পকেট ভরতেই ব্যস্ত!’ রাহুল প্রায়ই অভিযোগ করেন, দেশের ১৫–২০ জন শিল্পপতিকে কোটি কোটি টাকার কর মওকুফ করে তাদের পকেট ভরাতেই ব্যস্ত মোদি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং সমাজকর্মী জঁ দ্রেজ নিউজ বাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ‘সদ্য প্ৰকাশিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচক আরও একবার মনে করিয়ে দিল, বিশ্বের সবচাইতে অপুষ্টির দেশটি হচ্ছে ভারত। পরিতাপের বিষয় এই যে, ২০১৩ সালের জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন প্রবর্তিত হওয়ার পরও অপুষ্টিজনিত সমস্যা মোকাবিলায় এদেশে কোনো বড়সর উদ্যোগ চোখে পড়েনি। অথচ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বিপুল অর্থের যোগান ধরে, রাজনৈতিক মদতে কিনা শিশু পুষ্টি নিয়ে প্রকল্প শুরু করা হয়েছিল। ন্যূনতম খাদ্যের যোগান ছাড়া পুষ্টি নিয়ে ভাবার কি অবকাশ আছে?’
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১০৭টি দেশকে পাঁচটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। অপুষ্টি, শিশুমৃত্যু, পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুর উচ্চতার তুলনায় কম ওজন, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতার মতো কয়েকটি দিক-নির্দেশক বিষয়ের ওপর পয়েন্টের ভিত্তিতে ওই স্তরগুলি ভাগ করা হয়েছে। যেমন, যে দেশগুলির পয়েন্ট ৯ দশমিক ৯-এর নিচে, তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে অভুক্তের সংখ্যা ‘সবচেয়ে কম’ হিসাবে। এই স্তরে আছে চীন, বেলারুশ, ইউক্রেন, তুরস্ক, কিউবা, কুয়েত, বসনিয়া, ব্রাজিলসহ ৪৭টি দেশ।
দ্বিতীয় স্তরে আছে সেইসব দেশ, যাদের পয়েন্ট ১০ থেকে ১৯ দশমিক ৯-এর মধ্যে। এই স্তরকে বলা হচ্ছে ‘মাঝারি’। নেপাল, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ এই স্তরে আছে ২৬টি দেশ।
তৃতীয় স্তর হলো ২০ থেকে ৩৪ দশমিক ৯-এর মধ্যে পয়েন্ট পাওয়া দেশগুলিকে নিয়ে। এই স্তরকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘গুরুতর’ হিসাবে। এই স্তরে আছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিয়ানমার, ভারত, আফগানিস্তান, কঙ্গো, নাইজেরিয়াসহ ৩১টি দেশ। চতুর্থ স্তরে আছে সেইসব দেশ, যাদের পয়েন্ট ৩৫ থেকে ৪৯ দশমিক ৯-এর মধ্যে। ‘উদ্বেগজনক’ হিসাবে চিহ্নিত এই স্তরে আছে ৩টি দেশ-মাদাগাস্কার, টিমোর এবং চাদ।
‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ চিহ্নিত পঞ্চম স্তরটি হচ্ছে ৫০-এর ওপর পয়েন্ট পাওয়া দেশগুলির জন্য। ২০২০-এর রিপোর্ট অনুযায়ী এই স্তরে এবার কেউ নেই।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের ১৪ শতাংশ মানুষ অপুষ্টির শিকার। অপুষ্টিতে ভুগছে ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু। বয়সের অনুপাতে দৈর্ঘ্য এবং ওজন অনেক কম এমন শিশুর সংখ্যা ভারতে বাড়ছে। যার ফলে অপুষ্টিতে মৃত্যুও হচ্ছে অনেক শিশুর। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের এই পরিসংখ্যান ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য রীতিমতো উদ্বেগের।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকারি প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন ও নিয়মিত নজরদারির অভাবই ভারতের সমস্যার বড় কারণ। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে অবস্থার উন্নতি হলেই সার্বিকভাবে ভারতের স্থান উপরে উঠতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো পূর্ণিমা মেনন একটি ওয়েব পোর্টালে বলেছেন, ‘উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং মধ্যপ্রদেশের মতো কয়েকটি বড় রাজ্যে অপুষ্টির হার কমানো দরকার। তবেই গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ভারত উন্নতি করবে।’ তার কথায়, ‘ভারতে প্রতি পাঁচ শিশুর একজন জন্মগ্রহণ করে উত্তরপ্রদেশে। যে রাজ্যে জনঘনত্ব বেশি, সেখানে যদি বহু মানুষ অভুক্ত থাকেন, তাহলে সামগ্রিকভাবে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ভারতের অবস্থান নেমে যায়।’
ভারতে গত প্রায় দেড় দশক ধরে ‘খাদ্যের অধিকার’ আন্দোলনের নেত্রী ও সমাজকর্মী কবিতা শ্রীবাস্তবের মতে, বিশ্ব ক্ষুধা সূচক অনুযায়ী ১০৭টি দেশের মধ্যে ৯৪, খুবই খারাপ র্যাঙ্ক। এটা পূর্ব সময়ের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি। পরবর্তী বছরগুলিতে, বিশেষ করে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরে ভারতের ক্ষুধা সূচকের মানদণ্ডগুলি আরও নিম্নগামী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বর্তমান সময়ে কী হচ্ছে তা বোঝার জন্য নতুন তথ্য প্রয়োজন, যা বর্তমান সরকার কখনোই দেবে না।
কবিতা শ্রীবাস্তব বলেন, ‘প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ আমাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে সবক্ষেত্রে। মাথাপিছু গড় আয়, অপুষ্টির হার কমিয়ে আনা, জিডিপির হার বৃদ্ধি সবকিছুতেই তারা উন্নতি করছে। তারা একাধিক বিষয়ে মনোনিবেশ করেছে। নারী শিক্ষায় বাংলাদেশ আমাদের চেয়ে অনেক ভালো। এমনকি স্কুল শিক্ষায় কর্মসংস্থানেও বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে।’
আশিস গুপ্ত: সাংবাদিক, নয়াদিল্লি