বছর ঘুরে সবুজ পাহাড়ে বৈসাবি উৎসবের আমেজঃ শুরু হবে ‘ফুল বিজু’!!!


অনলাইন ডেস্ক প্রকাশের সময় :১১ এপ্রিল, ২০২২ ১০:৫৮ : অপরাহ্ণ 591 Views

নব আনন্দের বার্তা নিয়ে বছর ঘুরে পাহাড়ে আসে বৈসাবি উৎসব।তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে বাংলা বর্ষ বিদায় এবং বর্ষবরণে উদযাপন করা হয় বৈসাবি উৎসব।উৎসব আনন্দে জেগে উঠে পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠিসহ অনান্য জাতিগোষ্ঠিরা। পাহাড়ে বসে মিলন মেলা। প্রাণের উচ্ছাসে সকলের মন মাতিয়ে মনের রঙে আর আনন্দের যুক্ত মাত্রায় গ্রামে গ্রামে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে নানা বয়সের মানুষ। অরণ্যেঘেরা সবুজ পাহাড় বর্ণিল ঐতিহ্যবাহী পোশাক আর কৃষ্টি, সংস্কৃতিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষগুলো পালন করে বৃহত্তর এই সামাজিক উৎসব। এ উৎসবকে জাতিগোষ্ঠিরা ভিন্ন ভিন্ন নামে পালন করে থাকে। মুলত চাকমারা বিঝু, ত্রিপুরাদের ভাষায় বৈসুক, মারমাদের ভাষায় ‘সাংগ্রাই, তংচঙ্গ্যাদের ভাষায় বিসু এবং অহমিয়াদের ভাষায় বলা হয় বিহু। তবে ত্রিপুরা, মারমা এবং চাকমা এই তিন নৃ-গোষ্ঠীর উৎসবের নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে পাহাড়িদের এই উৎসবের নামকরণ হয়েছে বৈসাবি এবং নববর্ষসহ হয় বৈসাবীন।
পাহাড়ে পাহাড়ে বৈসাবির আমেজ তিন দিনব্যাপি এই উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা ‘ফুল বিজু বা ফুল বিঝু’ দ্বিতীয় দিনকে ‘মূল বিজু’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘নুয়াবঝর বা গোজ্যা পোজ্যা’ দিন বলেন। আর ত্রিপুরারা প্রথম দিনকে হারিকুইসুক দ্বিতীয় দিনকে বুইসুকমা এবং তৃতীয় দিনকে বিসিকাতাল নামে পরিচিত।
বৈসাবি উৎসব ঘিরে তিন দিন পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। পাহাড়িরা নানা আয়োজনে উদযাপন করে তাদের সবচেয়ে বড় এই সামাজিক উৎসব। বৈসাবি উপলক্ষে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে বৈসাবি উদযাপন কমিটির উদ্যোগে বর্ণাঢ্য আয়োজনে শোভাযাত্রাসহ নানা কর্মসূচী পালন করে।
এতে বর্ণিল পোশাকে নানা নৃ-গোষ্ঠির নিজস্ব পোশাকে নিজেদের ঐহিত্যকে ধারন করে বের করা হবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। তবে পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে নানা আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করার কথা থাকলেও তা সংক্ষিপ্ত করা হয় এবার।
বিঝু-পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে চাকমারা সংখ্যায় বেশি। বিঝু তাই এখানে এনে দেয় এক অন্য রকম অনূভুতি আর মোহনীয় আবেশ। এই উৎসবে সাড়া পড়ে যায় সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে। উৎসবের প্রথমদিনকে চাকমারা বলে ‘ফুল বিজু বা ফুল বিঝু’। এই দিন বিঝুর ফুল তোলা হয় এবং ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়। পরে সে ফুল দিন শেষে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বিঝুর সময় ছোট ছেলে-মেয়েরা পরিচ্ছন্ন কাপড় পড়ে দল বেঁধে বাড়ি-বাড়ি বেড়াতে যায়। তারা সবাই বয়স্কদের সম্ভাষণ করেন এবং ঘরের হাঁস-মুরগিকে ধান, চাল ছিটিয়ে খেতে দেওয়া হয়।
এই সময় ঘরে ঘরে রান্না হয় সুস্বাধু ‘পাজোন’। এটি চাকমাদের বিখ্যাত খাবার। হরেক রকম সবজি দিয়ে রান্না করা হয়। এই উৎসবে সবার প্রিয় খাবার এটি। ছেলে-মেয়েরা ঘিলা খেলা, গুদু (হা ডু-ডু) খেলায় মেতে ওঠে। তারা আকাশ প্রদীপ জ্বালায় এবং বাজি ফুটিয়ে আনন্দ করে। বয়স্করা দেশীয় মদ ‘জগরা বা ‘কাঞ্জি পান করেন। বিঝু উৎসবের সময় কোনো প্রাণি হত্যা করা হয় না। তবে নববর্ষের দিন মজার মজার সব খাবারের আয়োজন থাকে। এই দিন ভালো কিছু খেলে সারা বছরই ভালো খাবার সম্ভাবনা থাকে বলে বিশ্বাস করেন তারা।
বৈসুক: ত্রিপুরাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবের মধ্যে সবচে আকর্ষণীয় উৎসব বুইসুক বা বৈসুক। চৈত্রের শেষের দুইদিন ও নববর্ষের প্রথমদিন উদযাপন করা হয় এই উৎসব। চৈত্রের শেষ দুইদিনের প্রথমদিনকে ত্রিপুরারা ‘হারি বুইসুক এবং শেষ দিনকে ‘ বুইসুকমা বলে থাকে। আর নববর্ষের প্রথমদিনকে তারা বলে ‘ বিসিকাতাল।
উৎসবের প্রথমদিন ত্রিপুরা ছেলে-মেয়েরা ফুল তোলে। ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে। ঝুড়িতে ধান নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয়। গৃহপালিত সব প্রাণি ছেড়ে দেওয়া হয় খুব ভোরে। পরিচ্ছন্ন কাপড় পড়ে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় ছেলে-মেয়েরা। ছেলে-মেয়েদের বিচিত্র পিঠা আর বড়দের দেশীয় মদ ও অন্যান্য পানীয় পান করানো হয়। বৈসুক শুরুর দিন থেকে ‘গরয়া নৃত্য দল গ্রামের প্রতি ঘরের উঠানে নৃত্য পরিবেশন করে।
পাহাড়ে পাহাড়ে বৈসাবির আমেজ প্রত্যেক ঘরের উঠোনে ‘ গরয়া নৃত্য শেষে শিল্পীদের মুরগির বাচ্চা, চাউল প্রভৃতি দেওয়া হয়। এসব পেয়ে নৃত্যশিল্পীরা গৃহসত্ত’কে আশীর্বাদ করেন। নৃত্য শেষে শিল্পীরা উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া সামগ্রী দিয়ে গরয়া দেবতার পুজা করে। কোনো শিল্পী যদি একবার এই নৃত্যে অংশ নেন, তবে তাকে তিনবছর পর পর অংশ নিতে হয়। নয়তো তার অমঙ্গল এমনকি মৃত্যুও হয় বলে প্রচলিত ধারণা আছে। এই লোকনৃত্যে ১৬ জন থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ জন পযন্ত অংশ নিতে পারেন। এ নৃত্য দেখতে সারা দেশের শত শত সংস্কৃতিকর্মী ও শিল্পী পার্বত্য চট্টগ্রামে ভিড় করে।
সাংগ্রাই: বৈসাবি উৎসবের ‘সা অক্ষরটি অন্যতম ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ উৎসব থেকে নেওয়া। মারমাদের অন্যতম সামাজিক উৎসব সাংগ্রাই। বছরের শেষ দুইদিন এবং নববর্ষের প্রথমদিন এ উৎসব উদযাপন করা হয়। সাংগ্রাই উৎসব উদযাপনের সময় মারমা যুবক-যুবতীরা পিঠা বানাতে চালের গুড়া তৈরি করেন। এই সময় ‘পানি খেলা বা জলকেলি’ হয়। সাংগ্রাই উৎসব এবং জলখেলা এখন যেন একে অপরের সমার্থক হয়ে গেছে। এই খেলায় যুবক-যুবতীরা একে অপরের দিকে পানি ছুঁড়েন। ভিজিয়ে দেন পরস্পরকে। এছাড়া, মারমারা বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে ধর্মীয় বাণী শোনেন। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে এই উৎসব হয়। সেজন্য সংক্রান্তি শব্দ থেকেই সাংগ্রাই শব্দটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়।

ট্যাগ :

আরো সংবাদ

ফেইসবুকে আমরা



আর্কাইভ
September 2024
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31  
আলোচিত খবর

error: কি ব্যাপার মামা !!