উপলক্ষটা অনেক বড়। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইতিহাসে ১০০০তম ম্যাচ বলে কথা। ২০০৫ সালে শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম সংস্করণের হাজারতম ম্যাচটি খেলার সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ।
আর এ সুযোগটিকে স্মরণীয়ই করে রাখলেন মুশফিকুর রহীম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরা। দলের দুই প্রাণভোমরা সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালকে ছাড়াই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো ভারতকে হারিয়েছে বাংলাদেশ।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ঐতিহাসিক ম্যাচটিতে ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানেই জিতেছে টাইগাররা। স্বাগতিকদের করা ১৪৮ রানের জবাবে বারবার ম্যাচের ভাগ্য দুলেছে পেন্ডুলামের মতো। তবে শেষ হাসি হেসেছেন দুই ‘ভায়রা ভাই’ মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ-ই।
দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ের ম্যাচে বাংলাদেশ জিতেছে একদম শেষ ওভারে গিয়ে। অভিষিক্ত নাইম শেখ ২৬ ও আরেক বাঁহাতি সৌম্য সরকারের ৩৯ রানের ওপর দাঁড় করানো ভিতে, দালানের শেষ ইটটা বসান মুশফিকুর রহীম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
দুই ভায়রার অবিচ্ছিন্ন ৪০ রানের জুটিতে ম্যাচের ৩ বল বাকি থাকতেই জয় নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের। অভিষিক্ত শিভাম দুবের করা শেষ ওভারের তৃতীয় বলে অসাধারণ এক ছক্কা হাঁকিয়ে দলকে জেতান অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ।
টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে নিজের পঞ্চম ফিফটিতে মুশফিক অপরাজিত থাকেন ৬০ রান করে। মাহমুদউল্লাহর ব্যাট থেকে আসে ১৫ রান। এ জয়ের ফলে তিন ম্যাচ সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেলো
টাইগারদের ইনিংসে বারবার ঘুরেছে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ। কখনও মনে হয়েছে এগিয়ে বাংলাদেশ, ঠিক তখনই ঘুরে দাঁড়িয়েছে ভারত। চেপে ধরেছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের। তবে ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছেন নাইম ও সৌম্য। আর শেষদিকে দুর্দান্ত ফিনিশ করেছেন মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ।
অথচ ইনিংসের প্রথম বলে দারুণ কভার ড্রাইভে দুই আর পরের বলে কবজির আলতো টোকায় মিডউইকেট দিয়ে চার- বাংলাদেশের শুরুটা এমন দুর্দান্তই করেছিলেন লিটন। কিন্তু সে ওভারেই সাজঘরে ফিরে যান দলের অন্যতম স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান লিটন দাস।
তবে দ্বিতীয় উইকেটে ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেন অভিষিক্ত নাইম শেখ এবং ড্যাশিং সৌম্য সরকার। দুজনের দারুণ ব্যাটিংয়ে পাওয়ার প্লে’তে ৪৫ রান পায় বাংলাদেশ। রানরেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলে ৭ ওভারে ৫৩ রান জমা হয় স্কোরবোর্ডে।
কিন্তু অষ্টম ওভারে লেগস্পিনার ইয়ুজভেন্দ্র চাহাল আক্রমণে আসতেই বদলে যায় দৃশ্যপট। নিজের প্রথম ওভারেই ফিরিয়ে দেন নাইমকে। পরপর তিন বল ডট খেলায় আর মেজাজ ধরে রাখতে পারেননি তরুণ নাইম। ফলে হাওয়ায় ভাসিয়ে খেলার চেষ্টায় আউট হন ২৮ বলে ২৬ রান করে। নিজের অভিষেক ইনিংসটি তিনি সাজান ২ চার ও ১ ছয়ের মারে।
শুধু নাইমকে ফিরিয়েই থেমে থাকেননি চাহাল। নিজের প্রথম দুই ওভারে খরচ করেন মাত্র ২ রান। যার ফলে ৭ ওভারে ১/৫৩ থেকে ১০ ওভারে বাংলাদেশের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২/৬১ রানে। জয়ের জন্য রানের চাহিদা তখন পৌঁছে যায় ওভারপ্রতি প্রায় ৯ রানে।
এটিকে চাপ হিসেবে না নিয়ে ইতিবাচক ক্রিকেট খেলতে থাকেন মুশফিক ও সৌম্য। তবে বেশ ভাগ্যবানই বলা চলে মুশফিককে। কেননা চাহালের তৃতীয় ওভারে দুইবার নিশ্চিত লেগ বিফোরের হাত থেকে বেঁচে যান তিনি। তবে এসবকে থোড়াই কেয়ার করে সৌম্যকে নিয়ে গড়েন ৬০ রানের জুটি।
বেশ কিছুদিন ধরেই অফফর্মে থাকা সৌম্য দারুণ সঙ্গ দেন মুশফিককে। তবে শেষ করতে পারেননি ম্যাচ। ইনিংসের ১৭তম ওভারের শেষ বলে সরাসরি বোল্ড হয়ে ফিরে যান সাজঘরে। আউট হওয়ার আগে ১ চার ও ২ ছয়ের মারে ৩৫ বলে ৩৯ রান রান করেন তিনি।
তখনও ম্যাচ জয়ের জন্য বাংলাদেশকে করতে হতো ১৮ বলে ৩৫ রান। ঠিক তখনই নিজের তুরুপের তাসটি খেলে দেন রোহিত। লেগস্পিনার চাহালকে ডাকেন নিজের শেষ ওভার করার জন্য। তবে নিজের আগের তিন ওভারের মতো শেষ ওভারে আর পাত্তা পাননি চাহাল।
এতে অবশ্য ভাগ্যকে দুষতে পারেন চাহাল। কেননা সেই ওভারের তৃতীয় বলেই আউট হতে পারতেন মুশফিক। কিন্তু বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে সহজ ক্যাচ ছেড়ে দেন ক্রুনাল পান্ডিয়া। বাউন্ডারি পেয়ে যান মুশফিক। একই ওভারের শেষ বলে মাহমুদউল্লাহ আরেকটি বাউন্ডারি হাঁকালে ১৩ রান পায় বাংলাদেশ। সমীকরণ নেমে আসে ১২ বলে ২২ রানে।
আর তখনই ম্যাচ পুরোটা নিজেদের পকেটে পুরে নেন মুশফিক। খলিল আহমেদের করা সেই ওভারের শেষ চার বলে টানা বাউন্ডারি হাঁকিয়ে তুলে নেন ১৮টি রান। আর শেষ ওভারে বাকি থাকা ৪ রান করতে কোনো সমস্যাই হয়নি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের।
অষ্টম ওভারে উইকেটে এসে শেষপর্যন্ত দলকে জিতে মাঠ ছাড়ার পুরষ্কার হিসেবে ম্যাচসের নির্বাচিত হন মুশফিক। ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংসটিতে ৮ চার ও ১ ছয়ের মারে ৪৩ বলে ৬০ রান করেন তিনি।
এর আগে দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে টস জিতে প্রথমে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ দলের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। প্রথম ওভারে তিনি বল তুলে দেন শফিউল ইসলামের হাতে। শুরুটা হয়েছিল খুবই বাজে।
ওভারের প্রথম পাঁচ ডেলিভারিতে ১০ রান দিয়ে বসেন শফিউল। রোহিত শর্মা হাঁকান দুই বাউন্ডারি। তবে ভয়ংকর হয়ে ওঠতে থাকা রোহিতকে ঠিকই আটকে দেন শফিউল। পঞ্চম বলটিতে বাউন্ডারি হজম করেছিলেন। পরের বলটাই দুর্দান্ত এক ডেলিভারি দেন টাইগার পেসার, রোহিত বুঝতেই পারেননি। প্যাডে বল আঘাত হানে।
আবেদনে আঙুল তুলে দিতে দেরি করেননি আম্পায়ার। রোহিত অবশ্য রিভিউ নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। স্ট্যাম্প পেয়ে যায় বল। ফলে হতাশা নিয়েই সাজঘরে ফিরতে হয় ভারতীয় অধিনায়ককে (৫ বলে ৯)। ১০ রানে প্রথম উইকেট হারায় ভারত।
দ্বিতীয় উইকেটে সেই বিপদ কিছুটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেন শিখর ধাওয়ান আর লোকেশ রাহুল। তবে তাদের জুটিটাকে ২৬ রানের বেশি এগুতে দেননি বাংলাদেশ দলের তরুণ লেগস্পিনার বিপ্লব।
বিপ্লব ক্যারিয়ারের মাত্র দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নেমেছেন আজ। সপ্তম ওভারে বল করতে আসেন এই লেগি, আর প্রথম ওভারে বল হাতে নিয়েই পান উইকেটের দেখা। তার বাঁক খাওয়া ডেলিভারি বুঝতে না পেরে শর্ট কাভারে মাহমুদউল্লাহর সহজ ক্যাচ হয়েছেন লোকেশ রাহুল (১৭ বলে ১৫)।
ভারত ৩৬ রানে ২ উইকেট হারানোর পর উইকেটে এসে চালিয়ে খেলছিলেন শ্রেয়াস আয়ার, দ্রুত রানও তুলে দিচ্ছিলেন। অবশেষে এই ব্যাটসম্যানকেও সাজঘরের পথ দেখান বিপ্লব। ১৩ বলে ২২ রান করে আয়ার বাউন্ডারিতে ক্যাচ হন নাইম শেখের।
বাংলাদেশি বোলারদের এমন নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের মুখে খোলসে ঢুকে পড়েন ধাওয়ান। টি-টোয়েন্টিতে টেস্টের মতো টুকটুক করে খেলতে থাকেন বাঁহাতি এই ওপেনার। একটা সময় বলের তুলনায় রানে অনেক পিছিয়ে ছিলেন। পরের দিকে হাত খুলে কিছুটা ঘাটতি পোষানোর চেষ্টা করেেছিলেন ভারতীয় এই ওপেনার।
বল নষ্ট করার চাপটা তো মাথায় ছিলই। সেই চাপের মুখেই ৪২ বলে ৪১ রান করে রানআউটের কবলে পড়েন ধাওয়ান। মাহমুদউল্লাহর ওভারে সিঙ্গেলের জন্য দৌড়েছিলেন, কিন্তু অপরপ্রান্তে থাকা রিশাভ পান্ত সাড়া দেননি। মুশফিক বল পেয়ে স্ট্যাম্পটা ভেঙে দিতে ভুল করেননি।
এরপর উইকেটে আসেন শিভাম দুবে। অভিষেক ম্যাচে ব্যাটিংয়ে নেমে বেশ দেখেশুনে শুরু করেছিলেন এই অলরাউন্ডার। প্রথম তিন বল মোকাবেলায় করেন মাত্র ১ রান। চতুর্থ বলটিতেই পড়েন বিপদে। এমনই বিপদ, নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না দুবের।
ইনিংসের ১৬তম ওভার তখন। নিজের তৃতীয় ওভারে বল করতে আসেন আফিফ হোসেন ধ্রুব। তার ওভারের ষষ্ঠ ডেলিভারিটি বুঝতে না পেরে আলতোভাবে সোজা খেলে দেন দুবে, বল চলে যাচ্ছিল আফিফের মাথার ওপর দিয়ে। কে জানতো, এই বলটিও ধরে ফেলবেন তরুণ এই অলরাউন্ডার?
লাফিয়ে ওঠে বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে যেভাবে ক্যাচটি নেন আফিফ, দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামের হাজার হাজার দর্শক বোকা বনে যান। সবাই হা হয়ে থাকেন, এমন অবিশ্বাস্য ক্যাচও তালুবন্দী করা সম্ভব?
আফিফের এই ক্যাচে ১০২ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে বসে ভারত। বড় রানের আশা শেষ হয়ে যায় তখনই। ১৯তম ওভারে রিশাভ পান্তকেও তুলে নেন শফিউল। ২৬ বলে ২৭ রান করেন মারকুটে এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান।
তবে সপ্তম উইকেটে ক্রুনাল পান্ডিয়া আর ওয়াশিংটন সুন্দর ১০ বলের জুটিতে তুলে দেন ২৮ রান। সুন্দর ৫ বলে ১৪ আর ক্রুনাল ৮ বলে করেন অপরাজিত ১৫ রান।
বাংলাদেশের পক্ষে ২টি করে উইকেট নিয়েছেন আমিনুল ইসলাম বিপ্লব আর শফিউল ইসলাম।