গত অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ ৩০০ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর। এর আগে দেশের ইতিহাসে রাজস্ব সংগ্রহ কখনও তিন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়নি। আগের অর্থবছরে (২০২০-২১ ) ২ লাখ ৫৯ হাজার ৯০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এই হিসাবে গত অর্থবছরে প্রায় ৪০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বা ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মজিদ বলেন, তিন লাখ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আহরণ অবশ্যই একটি মাইলফলক। তবে কর -জিডিপির অনুপাত এখনও ১০ শতাংশের ঘরে আটকে রয়েছে। এখান থেকে এনবিআরকে বের হতে হবে।
এদিকে রাজস্ব আদায়ে রেকর্ড হলেও তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা কম। গত অর্থবছরে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সরকারের।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী গত অর্থবছর সবচেয়ে বেশি ১ লাখ ৮ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট থেকে। আগের অর্থবছরের তুলনায় যা ১১ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে ভ্যাট থেকে মোট আদায় হয়েছিল ৯৭ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরে আয়কর থেকে মোট আদায় হয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের তুলনায় যা ১৭ হাজার ১১৬ কোটি টাকা বা ২১ শতাংশ বেশি। ওই অর্থবছরে আদায় হয়েছিল ৮৫ হাজার ২২৪ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরে শুল্ক বিভাগ থেকে আদায় হয়েছে প্রায় ৮৯ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। এই খাত থেকে গত অর্থবছরের আদায় ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি। ওই অর্থবছরে শুল্ক খাত থেকে আদায় হয়েছিল ৭৭ হাজার কোটি টাকা।
কর -জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশের ঘরে
দেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর আদায়ের হার অনেক কম। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখন ১০ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। যেখানে নেপালে এই অনুপাত ২৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ এবং লাওসের ১৩ দশমিক ১৪ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। এ দুটি দেশের ২০২৬ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ ঘটবে।
শুধু তাই নয়, শ্রীলঙ্কা ছাড়া কর-জিডিপিতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার পরে। বাংলাদেশের এই হার প্রতিবেশী দেশ নেপালের অর্ধেকের চেয়েও কম। এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের অবস্থাও এদিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো।
কর-জিডিপি অনুপাতে এখন বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে কেবল দেউলিয়া হয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কা—৮ দশমিক ৯ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের প্রতিবেদনকে বিশ্লেষণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এ তথ্য তুলে ধরেছে। মধ্যমেয়াদী সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে তা প্রকাশ করা হয়েছে। নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০১৩-১৪ থেকে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ছিল গড়ে ১০ শতাংশের ঘরে।
এমনকি সাব-সাহারা আফ্রিকার দেশগুলোর কর-জিডিপি হারও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। কর-জিডিপি হারে নিকটতম প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও বাংলাদেশের তুলনা করা হয়েছে।
সাধারণভাবে জিডিপির অনুপাতে ৩০ শতাংশ আয়কর থেকে এলে সেটি একটি আদর্শ অবস্থা; কিন্তু ১৫ থেকে ২০ ভাগকেও ভালো অবস্থা ধরে নেওয়া যায়। বাংলাদেশে এই অনুপাত ১০ দশমিক ০৯ ভাগ।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির সাইজ ও বাংলাদেশের মানুষের গড় ইনকাম অনুযায়ী রাজস্ব আদায় আরও অন্তত ১০ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব।
দুই সপ্তাহ আগে সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদলও এ নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের বর্তমান এই সময়ে জিডিপির তুলনায় কম রাজস্ব আদায় নিয়ে বিপাকেই পড়ে আছে বাংলাদেশ।
রাজস্ব আদায় কম বলেই সরকারকে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করতে হচ্ছে। বিশেষ করে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি সামাল দিতে সরকারের কষ্ট হচ্ছে, আবার আরও মূল্যস্ফীতির আশঙ্কায় জ্বালানির দামও বাড়াতে পারছে না। একইসঙ্গে সরকারি অর্থায়নের প্রকল্পেও বরাদ্দ কমাতে হচ্ছে। সরকার এখন মূলত জ্বালানি চাহিদা কমবে, এমন সুযোগের অপেক্ষায় আছে।
প্রসঙ্গত, চলতি অর্থবছরের জন্য এনবিআরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা।
বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে শুল্ক-কর আদায়ে বেশি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের অর্থনীতিবিদেরা।
যদিও দেশের সবচেয়ে বড় শুল্ক–কর আদায়কারী সংস্থা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়েছে। গত অর্থবছরে (২০২১–২২) চট্টগ্রাম কাস্টমস ৫৯ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা আদায় করেছে। জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে শুল্ক–কর আদায় বেড়েছে। আবার কিছু পণ্যের ট্যারিফ মূল্য বৃদ্ধির কারণে রাজস্ব আদায় বেড়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের সিংহভাগ আমদানি–রফতানি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এনবিআরের প্রাথমিক হিসাব বলছে, গত অর্থবছরে তিন লাখ কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায় হয়েছে। সেই হিসাবে, এনবিআরের মোট রাজস্ব আদায়ের এক–পঞ্চমাংশ এসেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে।
গত বছরের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, ইস্পাতসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। এ কারণে শুল্কায়ন প্রক্রিয়ার ভিত্তিমূল্যও বেড়ে যায়। এতে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক–কর আদায় বৃদ্ধি পায়। আমদানি পর্যায়ে সারা বছর শুল্ক–কর আদায়ে ২০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ছিল।
তথ্য বলছে, ২০২০–২১ অর্থবছরে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ৫১ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা আদায় করেছে। অর্থাৎ আগেরবারের চেয়ে গত অর্থবছরে ৭ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা বেশি আদায় হয়েছে।
দেশের অর্থনীতি নিয়ে যা ভাবছে এনবিআর
এদিকে এনবিআর কর্মকর্তারা মনে করেন বৈশ্বিক পরিস্থিতি খারাপ থাকলেও দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থায় আছে। দেশের ভেতরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ভালো। অর্থনীতিতে গতি আছে। তাই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনের সুযোগ রয়েছে। গত ২৭ জুলাই অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের এমনটিই জানান।
বৈঠকে রাজস্ব আদায় বাড়াতে বৈঠকে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কিছু কৌশল অবলম্বনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে শুল্ক-কর বকেয়া রাখে কিংবা ফাঁকি দেয়, তাদের কাছ থেকে কর আদায় করতে হবে। আবার যারা নিয়মিত শুল্ক-কর দেয়, তাদের সঙ্গে আরও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখে আদায় বাড়াতে হবে। এ ছাড়া অর্থবছরের শুরু থেকেই শুল্ক-কর আদায়ে নজর দিতে হবে। বছরের শুরু থেকেই রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে বলা হয় কর্মকর্তাদের। বাজেটে ভ্যাট ও শুল্ক খাতে যেসব পরিবর্তন হয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে শুল্ক-কর বাড়ানোরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বৈঠকে। এ ছাড়া সৃজনশীল উপায়ে রাজস্ব আদায়ের নতুন নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে বকেয়া কর আদায়ে আরও বেশি মনোযোগী হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আনা ঠেকাতে কঠোর উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে।