তিন প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে থেকে একাই তিনি লুটে নিয়েছেন ৩ হাজার কোটি টাকা।এমনভাবেই তিনি লুটপাট করেছেন,যেন তার টাকায় প্রশান্ত মহাসাগরও ভরে যাবে।প্রতিষ্ঠিত এক বিজনেস ম্যাগনেটের হাতের ছোঁয়া ছিলো তার মাথার উপর। যে আশীর্বাদে ভর করে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সসহ একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার।
গত শুক্রবার জাতীয় দৈনিক সমকাল’র এক প্রতিবেদনে এমন ভয়াবহ দুর্নীতি-লুটপাটের চিত্র উঠে এসেছে।প্রতিবেদনে বলা হয়,দুদকের বেআইনি ক্যাসিনো ও মেগা দুর্নীতিবিরোধী টিম প্রশান্ত কুমারের লাগামহীন দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ নিয়ে কাজ শুরু করেছে।আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থেকে ঢালাওভাবে অর্থ লুটের অভিযোগের পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে পরোক্ষভাবে ক্যাসিনো বা বিভিন্ন জুয়াড়ি গ্রুপের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে।
দুদকের অনুরোধে গত ২৩ অক্টোবর প্রশান্ত কুমারের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।এই নিষেধাজ্ঞার পর তিনি প্রভাবশালী এক ব্যক্তির সহায়তায় কৌশলে দেশত্যাগের চেষ্টাও করছেন। প্রশান্তের বিরুদ্ধে অভিযোগটি অনুসন্ধান করছেন দুদকের ক্যাসিনোবিরোধী টিমের সদস্য ও উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান।
এরই মধ্যে দুদকে প্রশান্ত কুমারের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ জমা পড়েছে।অভিযোগটির প্রাথমিক অনুসন্ধানে একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তার অর্থ লোপাটের যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ মিলেছে।
দুদক সূত্র জানাচ্ছে,এমডির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের মাফিয়া ডন হয়ে উঠেছিলেন প্রশান্ত।তিনি পরোক্ষভাবে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে নানা কাজের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেখানে লুটপাটের স্বর্গরাজ্য কায়েম করেছিলেন। ২০১৫ থেকে চলতি বছরের প্রথম দিকের মধ্যে তিনি প্রভাব খাটিয়ে পিপলস লিজিংসহ একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
দুর্নীতির টাকায় প্রশান্ত বাড়ি,গাড়ি,ফ্ল্যাট,প্লট ছাড়াও বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন,ব্যাংকে এফডিআরসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছেন। তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ উঠেছে। এক প্রশান্তের নামেই তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদ-বিষয়টি রীতিমতো বিস্ময়কর অনুসন্ধানকারীদের কাছে।পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীদের কাছ থেকে অর্থ উত্তোলন,স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি,কোম্পানির পোর্টফোলিও থেকে গ্রাহকদের মার্জিন লোনের বিপরীতে শেয়ার বিক্রি ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহের নামে এ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।
এদিকে একই দিন জাতীয় দৈনিক যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,অন্তত ৩শ’ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচারের অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদারকে তলব করেছে দুদক।আগামী ১৪ নভেম্বর অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য দেয়ার জন্য হাজির হতে দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বৃহস্পতিবার নোটিশ জারি করেন।এছাড়া পৃথক চিঠিতে সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের বেশকিছু কাগজপত্রও চেয়েছেন দুদকের কর্মকর্তা।
দুদকের একজন কর্মকর্তা অভিযোগের বিষয় উল্লেখ করে জানান,প্রশান্ত কুমার হালদার রিলায়েন্স ফাইন্যান্সসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এমডি থাকা অবস্থায় তার আত্মীয়স্বজনকে আরও বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির ইনডিপেন্ডেন্ট পরিচালক বানান।একক কর্তৃত্বে অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে পিপলস লিজিংসহ বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির টাকা বিভিন্ন কৌশলে বের করে আত্মসাৎ করেন তিনি।পিপলস লিজিংয়ে আমানতকারীদের অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন কৌশলে আত্মসাৎ করেন।এর মাধ্যমে তিনি ওই কোম্পানিকে পথে বসিয়েছেন।এসব কোম্পানির স্থাবর সম্পদ বিক্রি করে দেন এবং আমানতকারীদের শেয়ার পোর্টফোলিও থেকে শেয়ার বিক্রি করে সমুদয় টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি।
এছাড়া প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক শুদ্ধি অভিযানের শুরুতে দুর্নীতি দমন কমিশন যে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে, তাঁদের মধ্যে প্রশান্ত কুমার হালদারও আছেন।
এদিকে প্রশান্ত কুমার হালদারের দুর্নীতি অনুসন্ধানের জন্য কিছু তথ্য চেয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠিয়েছেন দুদকের কর্মকর্তা।পিপলস লিজিং ও রিলায়েন্স লিজিংয়ে আলাদা চিঠি পাঠিয়ে ১৩ নভেম্বরের মধ্যে তথ্য ও নথি চাওয়া হয়েছে।
দুদকের চাওয়া তথ্যের মধ্যে রয়েছে পিপলস লিজিংয়ের পরিচালনা পর্ষদের নাম ও বিস্তারিত তথ্য।২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত আমানতকারীদের কাছ থেকে কত টাকা জমা নেওয়া হয়েছে, কত টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের কাছে কত টাকা জমা আছে,সে–সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কোন কোন ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানের হিসাব আছে,সেসব তথ্যের পাশাপাশি ব্যাংক হিসাবের বিবরণী চাওয়া হয়েছে।
২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত কোম্পানির কত স্থাবর সম্পদ বিক্রি করা হয়েছে এবং কোম্পানির শেয়ার পোর্টফোলিও থেকে গ্রাহকদের মার্জিন লোনের বিপরীতে কত টাকার শেয়ার বিক্রয় করা হয়েছে, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।ওই অর্থ দিয়ে কী করা হয়েছে বা কোথায় বিনিয়োগ করা হয়েছে,সে–সংক্রান্ত ব্যাংক হিসাব বিবরণী দিতে বলা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটিতে গ্রাহক ছাড়া আর কোন কোন প্রতিষ্ঠানের কত টাকা আমানত হিসেবে নেওয়া হয়েছিল এবং কোন কোন প্রতিষ্ঠানের কত টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে,তার বিস্তারিত তথ্য দিতে চিঠিতে বলা হয়েছে।ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের কাছ থেকে কত টাকা আমানত হিসেবে নেওয়া হয়েছিল বা কত টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে,তাও জানাতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের বিস্তারিত তথ্যের পাশাপাশি ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমানতকারীদের কাছ থেকে কত টাকা জমা নেওয়া হয়েছে,কত টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে,বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের কাছে কত টাকা জমা আছে,তার তথ্য চাওয়া হয়েছে।এ–সংক্রান্ত ব্যাংক হিসাবও চাওয়া হয়েছে।