মৎস্য বিভাগ বলছে, চলতি বছরের ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই ছিল সব ধরনের মাছ ধরায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা। কারণ এই সময়টা বঙ্গোপসাগরে মাছের প্রজনন ঋতু। ৬৫ দিনের সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর প্রথম পাঁচ দিনে সাগরে ইলিশের ঝাঁক মিলছিল। এ বছর পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ৪৬ হাজার কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছে, যা গত বছর ছিল ৩৬ হাজার কেজি। গতবারের চেয়ে এবার প্রায় দ্বিগুণ রাজস্ব আয় করেছে সরকার।
এবার প্রথম দিকে পাথরঘাটার আড়তে টনের পর টন ইলিশ নিয়ে আসে জেলে ট্রলারগুলো। কিন্তু দুই দিন হলো সেই চিত্র পাল্টে গেছ। চার-পাঁচ দিন সাগর ‘সেচে’ দু-এক ঝুড়ি ইলিশ নিয়ে ফিরছে একেকটি ট্রলার। খাটনি পোষাতে অন্য মাছ ধরার উপায় নেই। এমন পরিস্থিতি ছোট ট্রলারগুলোর। কারণ ইলিশ ধরার দুই ইঞ্চি ফাঁদি জালে অন্য মাছ আটকায় না।
পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের মার্কেটিং অফিসার বিপ্লব কুমার সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, গত বছরের ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা ওঠার পর প্রথম পাঁচ দিনে ৩৬ হাজার কেজি ইলিশ পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে এসেছিল। এতে রপ্তানিযোগ্য ২০ শতাংশ (৮০০ গ্রামের বড়) ইলিশ ছিল। এতে তখন গড়ে ইলিশের প্রতি কেজির দাম ছিল ৪১৯ টাকা। ছোট ইলিশ বেশি থাকায় রাজস্ব আয় হয়েছিল আড়াই লাখ টাকা। এবার গত পাঁচ দিনে ৪৬ হাজার কেজি ইলিশ কেন্দ্রে আসে। প্রায় ৫৫ শতাংশ ইলিশ রপ্তানিযোগ্য। তাই গড়ে প্রতি কেজি ইলিশ ৭২৭ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বড় ইলিশ বেশি থাকায় রাজস্ব আয় হয়েছে সাড়ে চার লাখ টাকা।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের আড়তদাররা বলেছেন, গত বছরের তুলনায় এবার মাছের আকার ভালো। প্রথম দিকে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে। এখন অনেকটাই কমে এসেছে। পাথরঘাটার জেলেরা বলছেন, ইলিশ ধরার অনুকূল পরিবেশ হলো পুবালি বাতাস আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি। এখন তেমন আবহাওয়া নেই। পাথরঘাটা ও কলাপাড়ার মৎস্যজীবী ও ব্যবসায়ীদের একাংশ বলছে, সম্প্রতি বন্যার তোড়ে দূষিত পানি সাগরে ঢুকেছে। ইলিশ ওখানে থাকতে পারছে না। চলে গেছে সমুদ্রের আরো নিচে। ট্রলারের জাল অতটা পৌঁছাতে পারছে না। দুর্যোগের জেরে ইলিশের ঝাঁক পথ পাল্টেছে।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক মো. লাকমান আলী মনে করেন, পুবালি বাতাস না পেয়ে ইলিশের ঝাঁক আসছে না। ইলিশ বিভিন্ন কারণে আচমকা গতিপথ পরিবর্তন করে। তাই হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য ইলিশ কম পাচ্ছেন জেলেরা। ইলিশের ঝাঁক কমে যাওয়ার পেছনে আবহাওয়ার বড় ভূমিকা দেখছেন তিনি। কারণ বৃষ্টির দেখা নেই। প্রচণ্ড গরম উপকূলজুড়ে। তবে যে জেলেরা বড় ফাঁসের লাল জাল নিয়ে গভীর সমুদ্রে যাচ্ছেন, তাঁরা কমবেশি মাছ পাচ্ছেন।
চাঁদপুরের চিত্র
চাঁদপুর বড়স্টেশন পাইকারি বাজারে গত শুক্রবার সকালে মাছ ব্যবসায়ী সম্রাট বেপারী জানান, প্রায় দুই দশকের ব্যবসার জীবনে তিনি এত বড় আকারের ইলিশ তেমন দেখেননি। তিনি দুই কেজি আকারের প্রতি মণ ইলিশের দাম হাঁকলেন ৭২ হাজার টাকা। ভোলার চরফ্যাশন থেকে ফিশিং বোটে করে ৪৫ মণ ইলিশ নিয়ে চাঁদপুরে এসেছেন ইসমাইল হোসেন। এর মধ্যে প্রায় ১০ মণ হবে দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের। জানালেন, সাগরে ধরা পড়ছে নানা আকারের ইলিশ। কিন্তু এবারেই প্রথম বড় আকারের ইলিশের পরিমাণ উল্লেখ করার মতো।
চাঁদপুরের পাইকারি মোকাম বড়স্টেশনে গত কয়েক দিন ইলিশে সয়লাব থাকলেও হঠাৎ দুই দিন ধরে কিছুটা কমেছে। তারপরও সরবরাহ বাড়ছে। অথচ দাম সাধারণ ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার নাগালে নেই।
নোয়াখালী সদরের চেয়ারম্যানঘাট থেকে পিকআপ ভরা ইলিশের চালান নিয়ে চাঁদপুর শহরের বড়স্টেশন পাইকারি মাছের আড়তে এসেছেন জেলেদের কাছ থেকে মোকামে সরবরাহকারী (বেপারী) নূর মোহাম্মদ। তিনি জানালেন, হাতিয়া ও তার আশপাশের উপকূলঘেঁষা মেঘনা নদী থেকে ধরা হচ্ছে এসব ইলিশ।
চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনা ছাড়াও পাশের শরীয়তপুর থেকে ইলিশ নিয়ে ফিরেছেন কয়েকজন মাছ বেপারী। হাইমচরের বেপারী আবু গাজী জানালেন, উজানের পানি তীব্র স্রোত নিয়ে দক্ষিণের ভাটিতে নামছে। এমন মোক্ষম সময় জেলেদের জালে ধরা পড়ছে ইলিশ। তবে পরিমাণে কম। তাই একটু বাড়তি দামেই জেলেদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে। চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির সভাপতি আব্দুল বারী জমাদার মানিক জানান, উপকূলীয় নদ-নদী এবং চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনায় ধরা পড়া ইলিশের চালান মিলছে এখানে। তবে চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ পর্যাপ্ত না হওয়ায় দাম কিছুটা বেশি।
ইলিশ জোরদারকরণ প্রকল্প পরিচালক আবুল বাশার জানান, সরকারের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়েছে। তাই বড় আকারের ইলিশ মিলছে। নিষেধাজ্ঞা, জাটকা ও মা ইলিশ সংরক্ষণের কারণে এবার ইলিশের উৎপাদন অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিউটি, নদীকেন্দ্র চাঁদপুরের প্রধান খোন্দকার রশীদুল হাসান জানান, দেশে ইলিশের ছয়টি অভয়াশ্রমের মধ্যে দুটির সীমানা বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছেন তাঁর সহকর্মীরা। শরীয়তপুরের অভয়াশ্রমটি পদ্মা সেতু এলাকা পর্যন্ত এবং লক্ষ্মীপুরের রামগতিতেও বিস্তৃত করা হবে। গবেষণায় দেখা যায়, এসব এলাকায় ইলিশের প্রাচুর্য রয়েছে। এত দিন এই দুটি এলাকা উন্মুক্ত ছিল। ফলে সরকারি নিষেধাজ্ঞার সময় সেখানে নির্বিচারে জাটকা ও মা ইলিশ ধরা হতো। অভয়াশ্রমে যুক্ত হলে ইলিশ উৎপাদনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
আলীপুর ও মহিপুরের চিত্র
কলাপাড়ার মৎস্যবন্দর আলীপুর ও মহিপুরে দেখা গেছে, সমুদ্র থেকে আসা ট্রলারগুলো থেকে ইলিশ খালাস করছেন শ্রমিকরা। সেখানে উপস্থিত মো. হারুন মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই যে মাছটি দেখছেন, এটির ওজন পৌনে দুই কেজি হবে। এই সাইজের ইলিশের প্রতি মণ বিক্রি হবে ৭০ হাজার টাকা। ৯০০ থেকে এক কেজি ওজনের প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৬০ হাজার টাকা। এর ছোটটা ৫০ হাজার এবং এর চেয়ে ছোটটা ৩৮ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’
ইলিশের আকার ও সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে বরিশাল মৎস্য অধিদপ্তরের ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিসারিজ প্রজেক্টে’র উপপরিচালক মো. কামরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইলিশের বিচরণকেন্দ্রিক নদ-নদীতে ও সাগরে অবৈধ জাল উদ্ধার অভিযান সফল হওয়া এবং বৈধ বড় ফাঁসের ভাসান জাল ব্যবহারে জেলেদের উদ্বুদ্ধ করায় জাটকা বা ছোট আকারের ইলিশ শিকার বন্ধ হয়েছে। একই সঙ্গে ২২ দিনের মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানকালীন প্রাপ্তবয়স্ক অসংখ্য ইলিশ জেলেদের আহরণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে। সর্বপরি ৬৫ দিনের সামুদ্রিক মৎস্য শিকার বন্ধ থাকায় দুই বছর বয়স্ক ইলিশের সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৯ থেকে চার বছর ৬৫ দিনের অবরোধ চলাকালে জেলেদের জালে ইলিশ শিকার না হওয়ায় ইলিশের উৎপাদন ও আকার বেড়েছে।
তিনি জানান, গত বছর ৫৬৫ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদন হয়। যার বাজারমূল্য ২৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি মৌসুমে ইলিশের উৎপাদন আরো বাড়বে।