আগামী ১০ বছরের মধ্যেই পুরোপুরি তৈরি হবে দেশের ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল। বর্তমানে ২৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির কাজ জোরেশোরে চলছে। এরই মধ্যে ৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের বেশকিছু ইউনিট উৎপাদন শুরু করে দেশের রপ্তানি আয়ে সুবাতাসও দিচ্ছে। সরকার আশা করে, এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘিরে বাড়তি ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি আয় সম্ভব। প্রায় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বিশেষ এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে ভারত, জাপান, চীন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, হংকং, সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি দেশ। এ পর্যন্ত তিনটি সরকারি ও ১০টি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে মোট ১ হাজার ৭৮৫ কোটি মার্কিন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় দেড় লাখ কোটি টাকারও বেশি।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) তথ্য মতে, ফেনীর সোনাগাজী, চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড ঘিরে ৩১ হাজার একর জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর’। এটি হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এখানকার শিল্প কারখানায় বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বলে জানিয়েছে বেজা। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ ও দেশের ১৫ লাখ মানুষের কাজের ঠিকানা হবে এ শিল্পনগরী। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ২৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরুর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এছাড়া ৩৭টি শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণাধীন। মিরসরাইয়ে ভারতের জন্য জমি রাখা হয়েছে ১ হাজার একরের মতো। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ প্রস্তাব ১ হাজার ২৩৯ কোটি ডলারের। এতে জমি নিয়েছে ৬৯টি প্রতিষ্ঠান। মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি নিয়েছে ২টি প্রতিষ্ঠান। তাদের বিনিয়োগ প্রস্তাবের পরিমাণ ২৪৮ কোটি ডলার। অন্যদিকে শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলের পুরো জমি নিয়ে নিয়েছে ৬টি প্রতিষ্ঠান। তাদের মোট বিনিয়োগ প্রস্তাব ১৩১ কোটি ডলার। শুধু ভারত নয়, জাপান ও চীনের জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারে। দুই ধাপে সেখানে মোট জমি দাঁড়াবে ১ হাজার একরের মতো। আর চীন চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৭৮৩ একর জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস সম্প্রতি বেজার এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ করোনাকালীন সময়েও দেশে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসছে এবং এতে প্রতীয়মান হয় বর্তমান সরকার বিনিয়োগবান্ধব সরকার। তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর হবে আগামী বাংলাদেশের বিনিয়োগের স্বপ্নের ঠিকানা। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আগামীতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগকারীদের সুবিধাদি বিবেচনায় নিয়ে কাজ করবে এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের হাত ধরে বাংলাদেশ বিনিয়োগবান্ধব সুস্থ পরিবেশ গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে এবং বিশ্বের কাছে উন্নয়নের একটি রোল মডেল স্থাপন করেছে। তিনি বলেন, সরকার ২০৩০ সাল নাগাদ ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ৯৩টি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন পেয়েছে। করোনার মধ্যেও বর্তমানে ২৮টি অঞ্চলের কাজ চলছে জোরেশোরে। এর মধ্যে ১৩টি সরকারি খাতের, বেসরকারি খাতের ১৫টি। পবন চৌধুরী আরো বলেন, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পর শুধু ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানই সৃষ্টি হবে না, বছরে অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন ডলারের পণ্যও রপ্তানি হবে। যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশকে উন্নত দেশ হতে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনা পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগ স্থানান্তরের একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সেটা হয়তো সময়ের ব্যাপার। তবে ওই সুযোগ ধরতে বাংলাদেশের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা দরকার। এ জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর কাজ দ্রুত এগিয়ে নেয়া দরকার। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো চালু হলে দেশ তার সুফল পেতে থাকবে। মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোতেও অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগ টানতে বাংলাদেশ বিশেষ কী দিতে পারবে, সেটাও বিবেচনার বিষয়।
এদিকে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগের জন্য জমি নিয়েছে বিদেশি বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে জাপানের হোন্ডা মোটর করপোরেশন, দক্ষিণ কোরিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম কোম্পানি এস কে গ্যাস, বিশে^র তৃতীয় বড় ইস্পাত উৎপাদক প্রতিষ্ঠান জাপানের নিপ্পন স্টিল, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে খেলনা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মেইগো লিমিটেড, ভারতের আদানি ও সিঙ্গাপুরের উইলমারের যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড, রং উৎপাদনকারী বার্জার ও এশিয়ান পেইন্টস, যুক্তরাজ্যের ইউরেশিয়া গুডস এবং চীনের বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় শিল্প পরিবার বসুন্ধরা গ্রুপ, এসিআই, পিএইচপি, বিএসআরএম, অনন্ত গ্রুপ, ডিবিএল গ্রুপ, এনার্জি প্যাক, সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট, টিকে গ্রুপসহ অনেক প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি নিয়েছে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে এখন বিনিয়োগের সবচেয়ে উত্তম পরিবেশ। এমন পরিবেশ পেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন ঢাকায় আসছেন। বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে ব্যবসা স্থানান্তর করতে চান বিদেশিরা। এর সঙ্গে দেশি বিনিয়োগকারীদেরও সক্ষমতা বাড়ছে।
আরো দুই চীনা বিনিয়োগ আসছে : চীন থেকে বাংলাদেশে একের পর এক বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন লিমিটেড (সিসিইসিসি) এবং জিহং মেডিকেল প্রোডাক্টস লিমিটেড নামের দুটি চীনভিত্তিক কোম্পানি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে কারখানা নির্মাণ করতে যাচ্ছে। দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে ১০ একর জায়গা চেয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) কাছে আবেদন করেছে সিসিইসিসি। একই শিল্পনগরে ৮ একর জায়গা চেয়েছে জিহং মেডিকেল প্রোডাক্টস লিমিটেড।
এ দুটি বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগ প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে জমি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেজা। তারই অংশ হিসেবে সম্প্রতি সোনারগাঁও হোটেলে চীনা দুটি কোম্পানির সঙ্গে জমির ইজারা চুক্তি করে বেজা। এর আগে গত আগস্টে করোনা মহামারির মধ্যে চীনের আরেকটি কোম্পানি ইয়াবাং গ্রæপকে ১০০ একর জমি লিজ দিয়েছিল বেজা। সেখানে কোম্পানিটি ৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে বলে জানিয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ২ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে পবন চৌধুরী বলেন, করোনার মধ্যে বিদেশি কোম্পানিগুলো যেভাবে অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে, আমরা অবশ্যই তাদের সাধুবাদ জানাই। মহামারির মধ্যে বিনিয়োগ করতে আসার মানে হলো, তাদের আমরা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছি। নতুন দুটি কোম্পানিকে আমরা জমি ইজারা দিতে যাচ্ছি। দুটি কোম্পানিই শতভাগ রপ্তানিমুখী। জমি লিজ পাওয়ার পর তারা যত দ্রুত সম্ভব কারখানা নির্মাণ শুরু করতে চায়।
জানা গেছে, সিসিইসিসি ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি। নির্মাণশিল্পে যেসব কাঁচামাল প্রয়োজন হয়, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে জমি পেলে তারা সেই কাঁচামাল উৎপাদন করবে। বিশেষ করে স্টিল তৈরির কাঁচামাল। তথ্য বলছে, সিসিইসিসি বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে প্রাথমিকভাবে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করবে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৩৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে জিহং মেডিকেল প্রোডাক্টস কোম্পানি লিমিটেড অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি পেলে স্বাস্থ্য সরঞ্জাম তথা আইসোলেশন গাউন, ল্যাব জ্যাকেট, ডিসপোজিবল ক্যাপ, বুট কভার, শু-কভার প্রভৃতি তৈরি করবে। কোম্পানিটি প্রাথমিকভাবে ১ কোটি ২৭ লাখ ডলার বিনিয়োগ করবে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১০৮ কোটি টাকা।
অর্থনৈতিক অঞ্চলে হঠাৎ সার্ভিস চার্জ : গত ৩ সেপ্টেম্বর বেজা থেকে জারি করা সার্কুলার অনুযায়ী, সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প-কারখানায় পানির সংযোগ নেয়ার পর পানির বিল দেয়ার পাশাপাশি একজন বিনিয়োগকারীকে বাড়তি ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। একইভাবে গ্যাস সংযোগ নেয়ার পর গ্যাস বিল দেয়ার পাশাপাশি বাড়তি ৫ শতাংশ সেবা খরচ গুনতে হবে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও বাড়তি ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। বেজা বলছে, শিল্পকারখানা থেকে তৈরি হওয়া ময়লা পানি পরিশোধন করতে চাইলে সেখানেও ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। আবার তরল বর্জ্য শোধন করতে চাইলে সেখানেও আলাদা করে ৫ শতাংশ সেবা খরচ দিতে হবে ব্যবসায়ীদের। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের ইজারা নেয়া জমির মূল্যের ওপর ভ্যাট না থাকলেও এখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলছে, ইজারা নেয়া জমির মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। ব্যবসায়ীদের জন্য থাকছে না টানা ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধাও। বেজা বলছে, যে কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইজারা নেয়া প্রতি বর্গমিটার জমি বা অবকাঠামোর ওপর বার্ষিক শূন্য দশমিক ০৫ ডলার হারে রক্ষণাবেক্ষণ চার্জও দিতে হবে।
জানা গেছে, বিনিয়োগকারীরা যখন বেজার কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়েছিলেন, তখন গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ বিভিন্ন পরিষেবার ওপর অতিরিক্ত মাসুলের কথা চুক্তিতে ছিল না। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীরা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে পবন চৌধুরী বলেন, জমি ক্রয়ে ভ্যাট আরোপের বিষয়টি এবারই প্রথম হয়নি। আগের বাজেটে সেটা হয়েছিল। ব্যবসায়ীরা চান এটা প্রত্যাহার হোক। আমরাও মনে করি এটা না থাকাই ভালো। এতে ‘কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস’ অনেক বেড়ে যায়। ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করতে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, এনবিআরসহ বিভিন্ন জায়গায় অনুরোধ করেছি। আশা করছি, এ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হবে।
Publisher - Lutfur Rahman (Uzzal)
Published By The Editor From chttimes (Pvt.) Limited (Reg.No:-chttimes-83/2016)
Main Road,Gurosthan Mosque Market, Infront of district food Storage, Bandarban hill district,Bandarban.
Phone - News - 01673718271 Ad - 01876045846
Copyright © 2024 Chttimes.com. All rights reserved.