ড. প্রণব কুমার পাণ্ডেঃ
গত দুই বছর কভিড-১৯ অতিমারির প্রভাবে বিশ্বের প্রায় সব দেশের স্বাস্থ্য খাত এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি খুব খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে পাড়ি দিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে করোনার নেতিবাচক প্রভাবের কারণে অনেক দেশ হিমশিম খেয়েছে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করার ক্ষেত্রে। বিশ্বের কোনো কোনো শক্তিশালী অর্থনীতির দেশও করোনার নেতিবাচক প্রভাব সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। আবার অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ কোনো কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একেবারেই কমে গেছে। ঠিক সেই সময়ে বাংলাদেশ সফলভাবে কভিড-১৯-এর প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপের ধাক্কাই শুধু মোকাবিলা করেনি, একই সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। যেখানে গত দুই বছরে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশের নিচে ছিল, তখন বাংলাদেশে ৬ শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন।
গত বছরের শেষদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানায় চিহ্নিত হওয়া করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে নতুনভাবে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আমরাও এর বাইরে নই। গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে যুক্তরাষ্ট্র- যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে শুরু করেছে। এই ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের ফলে আগামী দিনে বিভিন্ন দেশের প্রবৃদ্ধি হুমকির সম্মুখীন হতে চলেছে। ফলে ২০২৩ সালে অনেক দেশেরই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়েও বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের চেয়ে বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও তার অগ্রগতি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ এবং পরবর্তী অর্থবছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে শুধু ভারত বাংলাদেশকে পেছনে ফেলতে পারলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে গোটা বিশ্বকে পেছনে ফেলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বাংলাদেশ, যা হবে সত্যিই বিস্ময়কর অর্জন।
করোনাকালে আমরা যদি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি অর্জনের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে দেখতে পাব ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জনের হার হবে ২ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে এই সময়ে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে ৬ শতাংশের ওপরে। জাপানের মতো দেশেও প্রবৃদ্ধির হার কমার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্বব্যাংক যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেটি মূলত ওমিক্রনের কারণে অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে, তা মাথায় রেখেই করেছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারেও ইতিবাচক হাওয়া বইছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক। আর এই কারনেই রপ্তানি খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি একই সময়ে শ্রম আয় এবং রেমিট্যান্স বেড়েছে। আর এই কারণেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে দেশের অর্থনীতির আকার প্রথমবারের মতো চলতি মাসে এক হাজার বিলিয়ন ডলার বা এক ট্রিলিয়ন ডলারের মাইলফলক পেরিয়েছে বলে প্রক্ষেপণ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। এর ঠিক চার বছর পরে অর্থাৎ ২০২৬ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি দেড় ট্রিলিয়ন ডলার হবে বলে আশা করছে আইএমএফ। প্রশ্ন হচ্ছে, করোনা দুর্যোগেও বাংলাদেশের এই অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতির কারণ কী? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব। তার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই দেশের অর্থনীতি আজকে শক্ত ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়েছে।২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন। আর এই কারণেই দেশে বিভিন্ন জনবান্ধব পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করেছে তার সরকার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প, যেগুলোকে আমরা মেগা প্রকল্প বলতে পারি; এগুলোর বাস্তবায়নের কাজ চলছে পুরোদমে। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কপবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প ও সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প ইত্যাদি। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি আরও বেগবান হবে। সরকার চলতি বছরের জুন মাসে পদ্মা সেতু, ডিসেম্বর মাসে মেট্রোরেল এবং কর্ণফুলী টানেল খুলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। এসব মেগা প্রকল্পের সমাপ্তি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে অর্থনীতিতে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার ধারাবাহিকতাও এই অভূতপূর্ব অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্যের অভাব রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববর্তী সরকারের সকল কার্যক্রমের বাস্তবায়ন বন্ধ হয়ে যায়। এদিক থেকে বিচার করলে ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৩ বছর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকার ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন সহজ হয়েছে।
২০২০ সালে যখন করোনা অতিমারি তাণ্ডব শুরু হয়, সেই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দেশ মনে করেছিল বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হতে পারে এবং অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেত্বত্ব গোটা বিশ্ব অবাক দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করছে গত ১৩ বছর। এর মধ্যে গত দু’বছরে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হওয়ার সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশ আজ একদিকে যেমন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, অন্যদিকে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ বা এশিয়ান টাইগার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বিশ্ব মানচিত্রে। যারা এক সময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে বর্ণনা করেছিল, তারাই আজ বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসা করছে।
লেখকঃ অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়