দেশের ৯০ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য বিশেষ বয়স্ক ভাতা চালু করতে যাচ্ছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে নীতিমালা তৈরিসহ একটি প্রস্তাব তৈরির কাজ করছে। এই প্রস্তাবে অর্থ মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে আগামী অর্থবছর থেকেই বিশেষ বয়স্ক ভাতা চালু করা যাবে বলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। খসড়া প্রস্তাব অনুযায়ী, এই কর্মসূচীর আওতায় ৯০ বছরের বেশি বয়সীদের প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। বর্তমানে দেশে মোট ৪৯ লাখ মানুষকে বয়স্ক ভাতা দেয়া হয়। এরমধ্যে ২ লাখ মানুষের বয়স ৯০ বছরের বেশি। ৯০ বছরের বেশি বয়সীদের বিশেষ বয়স্ক ভাতা চালু হলে, তারা এটা (বয়স্ক ভাতা) থেকে আলাদা হয়ে যাবেন।
দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য কমানো এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে সরকার। সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত মোট ১২৬টি কার্যক্রম ২৫টি মন্ত্রণালয়/বিভাগ বাস্তবায়ন করছে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জানা গেছে। প্রতিবছরই ভাতাভোগীর সংখ্যা ও বরাদ্দ বাড়ছে।
প্রবীণ ব্যক্তিদের সামাজিক নিরাপত্তায় রয়েছে সরকারের বয়স্ক ভাতা কর্মসূচী। বর্তমানে এই কর্মসূচীর আওতায় ৪৯ লাখ দরিদ্র প্রবীণ ব্যক্তিকে প্রতিমাসে ৫০০ টাকা করে দেয়া হচ্ছে। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ৮০ বা এর বেশি বয়সীরা বেশি অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে রয়েছেন। সরকার এরমধ্যে ৯০ বছরের বেশি বয়সীদের বিশেষ নজর দিতে চায়, এজন্য বিশেষ বয়স্ক ভাতা চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
বিগত মাসে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটির চতুর্দশ সভার কার্যপত্রে উল্লেখ রয়েছে সভায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম-সচিব মোহাম্মদ খালেদ হাসান তার উপস্থাপনায় বলেন, (সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী) সামগ্রিক অগ্রগতি যথেষ্ট সন্তোষজনক হলেও কতিপয় ক্ষেত্রে কিছুটা পশ্চাৎপদতা রয়েছে। বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা ৩০ লাখ থেকে ৬৫ লাখে উন্নীত করার পরিকল্পনা ছিল, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ভাতাভোগীর সংখ্যা ৪৯ লাখে বৃদ্ধি করেছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় অগ্রগতি যথেষ্ট সন্তোষজনক। কিন্তু ৯০ বছরের উর্ধে জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ভাতা কর্মসূচী প্রবর্তনের যে প্রস্তাব ছিল তা এখনও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
সভার সভাপতি ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব এ বিষয়ে জরুরী ভিত্তিতে কার্যক্রম গ্রহণের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে অনুরোধ করেন বলে কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বাজেট, কার্যক্রম ও মূল্যায়ন) বলেন, এ বিষয়ে (৯০ বছরের বেশি বয়সীদের বিশেষ ভাতা) সিএমসি (সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি) সভার একটা সিদ্ধান্ত আছে। আমরাও এগোচ্ছি, একটা মিটিংও করেছি। তবে বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। আমরা আমাদের প্রস্তাব চূড়ান্ত করব, সরকার দেবে কী দেবে না সেটা সরকারের সিদ্ধান্ত। পুরো বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করছে।
তিনি বলেন, ৯০ বছরোর্ধ জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ বয়স্ক ভাতা দিতে আমরা একটি নীতিমালা করছি। নীতিমালা অনুযায়ী আমরা এই ভাতাটা দেব। আমাদের প্রস্তুতি শেষ হলে আমরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানাব। তবে করোনা পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে। পরিস্থিতি যদি আরও অবনতি হয় তবে হয়ত এই উদ্যোগটি বাস্তবায়নে কিছুটা বিলম্ব হবে।
বিশেষ ভাতা কর্মসূচীর আওতায় যাদের বয়স ৯০ বছরের বেশি হবে তাদের প্রতিমাসে তিন হাজার টাকা করে দেয়া হবে। এখন প্রতিমাসে বয়স্ক ভাতা ৫০০ টাকা। বর্তমানে ৪৯ লাখ মানুষকে বয়স্ক ভাতা দেয়া হচ্ছে জানিয়ে অতিরিক্ত সচিব বলেন, আমরা হিসাব করে দেখেছি, এরমধ্যে ২ লাখ মানুষের বয়স ৯০ বছরের বেশি। ৯০ বছরের বেশি বয়সীদের বিশেষ বয়স্ক ভাতা চালু হলে তারা এটা (বয়স্ক ভাতা) থেকে আলাদা হয়ে যাবেন। যদি তাদের তিন হাজার টাকা দেয়া হয় তবে আমাদের আরও যোগ করতে হবে আড়াই হাজার টাকা। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী অর্থবছর থেকে বিশেষ বয়স্ক ভাতা চালু করা হবে জানিয়ে ইসমাইল হোসেন বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মোট ২৫টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর ভাতাভোগীর সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ মানুষ। এতে আমাদের লাগে ৭ হাজার কোটি টাকা।
অবহেলিত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সামাজিক অবস্থার উন্নতিতে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছর থেকে সরকার বয়স্ক ভাতা কার্যক্রম চালু করে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন বয়স্ক ভাতা কর্মসূচীর আওতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। বর্তমান ২০২০-২১ অর্থবছরে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা ৫ লাখ বাড়িয়ে ৪৯ লাখ করা হয়েছে। এ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করে ২ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা করা হয়েছে। ১৯৯৮-৯৯ সালের বরাদ্দ থেকে বর্তমান অর্থবছরে বরাদ্দের গড় বৃদ্ধির হার ২০ দশমিক ৫১ শতাংশ। বর্তমানে জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা করে ভাতা দেয়া হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে ৪ লাখ ৪ হাজার ব্যক্তিকে বয়স্ক ভাতা দেয়া হয়। তখন প্রতিমাসে ১০০ টাকা করে ভাতা দেয়া হতো। ওই অর্থবছরে এই খাতে ৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। পরেরবছর ভাতাভোগীর সংখ্যা বেড়ে হয় ৪ লাখ ১৭ হাজার। এজন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ৫০ কোটি টাকা। ২০০০-০১ অর্থবছর ভাতা বাড়িয়ে ২০০ টাকা করা হয়। ভাতাভোগীর সংখ্যাও এক সঙ্গে ১১ লাখ ৮৩ হাজার বাড়িয়ে ১৬ লাখ করা হয়। তখন ৩৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
২০০৯-১০ অর্থবছরে ভাতা আরও ১০০ টাকা বেড়ে হয় ৩০০ টাকা। ওই বছর ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় সাড়ে ২২ লাখ। এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভাতা বেড়ে হয় ৫০০ টাকা। এই অর্থবছরে ভাতাভোগীর সংখ্যা হয় ৪০ লাখ। বরাদ্দ দেয়া হয় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। পরের বছর (২০১৯-২০) ৪৪ লাখ মানুষকে বয়স্ক ভাতা দেয়া হয়। এদের ভাতা দিতে বরাদ্দ দেয়া হয় ২ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা।