দেশের সবচেয়ে বড় কৃষি ফসল বোরো ঘরে তুলতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় এবছর বোরো ধান কাটার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। সঙ্কট এলাকাগুলোতে শ্রমিকদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগাম বন্যা ও বিরূপ আবহাওয়া থেকে রক্ষা পেতে দ্রুত ধান কাটার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে সিলেট বিভাগের হাওড়াঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায়। সেইসঙ্গে, কম্বাইন্ড হারভেস্টর, রিপারসহ পর্যাপ্ত ধান কাটার যন্ত্র হাওড়ে এ বছর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
বর্তমানে হাওড় অঞ্চলের চিত্র হলো, জমিতে পাকা ধানের ছড়া বাতাসে নুয়ে পড়েছে। সবুজের বুকে এখন তাই সোনালি আভার আধিক্য। বাতাসে ভেসে আসা শিষের শব্দে আনন্দিত চাষী। তার হাসির ঝলক ফসলের মাঠ থেকে ছড়িয়ে পড়ে নীল দিগন্তে। বেশির ভাগ এলাকায়ই এখন কৃষকরা পাকা ধান কাটতে জমিতে চলে এসেছেন। বিভিন্ন হাওড়ে শ্রমিকরা ধান কাটছেন। ফলে ধান কাটা নিয়ে তাদের ব্যস্ততা বেড়েছে ভীষণ। কৃষি বিভাগের দ্রুত ধান কেটে ঘরে তোলার জন্য আগাম সতর্কতায় এ ব্যস্ততা আরও বেড়ে গেছে।
আগাম বন্যার শঙ্কায় নেত্রকোনার হাওড়াঞ্চলের কৃষকদের ২৫ এপ্রিলের মধ্যে ৮০ শতাংশ ধান কাটার পরামর্শ দিয়েছে কৃষি বিভাগ। এই খবর জেনে গেছে আশপাশের জেলার চাষীরাও। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দেয়ার আগেই ফসল ঘরে তুলতে চান তারা।
অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলের আশঙ্কায় নেত্রকোনার হাওড়াঞ্চলে দ্রুতগতিতে ধান কাটার পরামর্শ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। কারণ, কালবৈশাখী ঝড় ও আগাম বন্যায় পাকা ধান মাঠে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের সার্বিক তত্ত্বাবধানে হাওড়াঞ্চলে অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে শতাধিক কম্বাইন্ড হারভেস্টরের মাধ্যমে দ্রুত গতিতে চলছে এই ধান কর্তন। কৃষি বিভাগ বলছে, এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি অনুকূলে রয়েছে। এছাড়া পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রমিক হাওড়াঞ্চলে ধান কাটছেন।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় জেলায় এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এ বছর হাওড়ে ধান লাগানোর পর কোন বৃষ্টিপাত হয়নি। যে কারণে ধানে কিছু চিটার পরিমাণ আছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। এ কারণে ফলনে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, ফলনে তেমন তারতম্য হবে না। কারণ এবছর আবাদ বেশি হয়েছে। ফলনও ভালও হয়েছে।
গত ১৭ এপ্রিল মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার পালের মুড়া এলাকায় হাকালুকি হাওড়ে বোরো ধানের নমুনা শস্য কাটা হয়। হাকালুকি হাওড়ে প্রতি হেক্টরে কী পরিমাণ ধান হবে তা যাচাইয়ের জন্য বোরো ধানের নমুনা শস্য কাটা হয়েছে। এটি হলো ব্রি-৮৫ ধান। কাঁচা অবস্থায় এর আর্দ্রতা ২৩ শতাংশ। শুকানো অবস্থায় আর্দ্রতা হবে ১৪ শতাংশ। প্রতি হেক্টরে কাঁচা ধানের ওজন ৭ দশমিক ২৫ টন। শুকনো ধানের ওজন হবে ৬ দশমিক ৪৯ টন। আর সেখান থেকে চাল হবে ৪ দশমিক ২৮ টন। আর প্রতি বিঘায় ২১ থেকে ২৩ মণ হারে ধানের ফলন হয়েছে।
জানা যায়, সারাদেশে যে পরিমাণ বোরো উৎপাদন হয়, এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হাওড়াঞ্চল থেকে আসে। তাই কোন কারণে হাওড়াঞ্চলের বোরো উৎপাদন মার খেলে তার প্রভাব পড়ে সামগ্রিক ধান উৎপাদনের ওপর। শুধু যে ধান-চালের দামের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তা-ই নয়, ভেঙ্গে যায় কৃষকের মেরুদ-ও।
তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। শুধু হাওড়াঞ্চলের অবস্থা ভাল তা-ই নয়, সারাদেশেও আবাদের অবস্থা ভাল। কৃষক ও মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বড় ধরনের কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে দেশে এবার বোরোর বাম্পার ফলন হবে। শুধু তাই নয়, গত বারের চেয়ে অন্তত ৫ লাখ টন চাল বেশি উৎপাদন হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ বিভাগ) মোঃ হাসানুজ্জামান কল্লোল জানিয়েছেন, ধান কাটা শুরুর আগেই কৃষকের কাছে যন্ত্র পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একেকটি যন্ত্র ৮০ জন শ্রমিকের কাজ করে দেবে। এছাড়া গত বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আগে থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নেয়া আছে। স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইতোমধ্যেই শ্রমিকের যাতায়াতসহ সার্বিক বিষয়ে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। কৃষি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সবাই মাঠে কৃষকের পাশে থেকে কাজ করছেন। ফলে আশা করা যাচ্ছে, এবছর নির্বিঘ্নে কৃষকরা ধান ঘরে তুলতে পারবেন।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পের মাধ্যমে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে সারাদেশে ৫০০ উপজেলায় ১৬১৭টি কম্বাইন্ড হারভেস্টর, ৭০১টি রিপার, ১৮৪টি রাইস ট্রান্সপ্লান্টারসহ মোট ৫ হাজার ৭৭৬টি বিভিন্ন ধরনের কৃষিযন্ত্র কৃষকের মধ্যে দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে হাওড়ে ধান সফলভাবে কাটার জন্য ৫১০টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও ২৩১টি রিপার দেয়া হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ আসাদুল্লাহ জানান, এ বছর শ্রমিক সঙ্কট হওয়ার আশঙ্কা নেই। আমরা অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে শুরুতেই যন্ত্র পৌঁছে দিচ্ছি কৃষকের কাছে। একটা কম্বাইন্ড হারভেস্টর ৮০ জনের বেশি শ্রমিকের কাজ করবে। ৫০০ উপজেলায় দেড় হাজারের বেশি এ যন্ত্র দেয়া হচ্ছে।
তিনি জানান, এই যন্ত্রগুলো শুধু একটি এলাকার জন্যে না। দেখা গেল হাওড়ে ধান কাটা শেষ, তখন চলে যাবে অন্য এলাকায়। আমরা শুরু থেকেই করোনাভাইরাসকে গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ নিয়েছি। কৃষিমন্ত্রীর নির্দেশনা আর মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় মাঠ পর্যায়ে কাজ চলছে। ধান উৎপাদনের সবচেয়ে বড় সময় হলো বোরো মৌসুম। এ সময়ে যেন কোন সমস্যা তৈরি না হয় সেদিকে সর্বোচ্চ নজর দেয়া হচ্ছে।
হাওড়ে দ্রুত ধান কাটতে মাইকিং ॥ আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সামনের দিনগুলোতে ঘূর্ণিঝড়সহ ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। প্রায় প্রতি রাতে বৃষ্টিও হচ্ছে। ফলে বন্যা ও ঝড়-বৃষ্টির কারণে খেতের বোরো ধানের ক্ষতি হতে পারে। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগে পুরো ফসল যেন নষ্ট না হয়, সেজন্য মাইকিংয়ে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
জানা যায়, বিরূপ আবহাওয়া থেকে বোরো ধান বাঁচাতে দ্রুত ধান কাটতে মাইকিং করা হচ্ছে সিলেট বিভাগের হাওড়াঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায়। বিশেষ করে, সিলেট বিভাগের হাওড় এলাকাগুলোতে প্রতিদিন সিডিউল করে মাইকিং করা হচ্ছে। বৃষ্টিতে বোরো ধান যেন আরও পোক্ত হয় সেজন্য অনেক কৃষক অপেক্ষা করছেন। কিন্তু কৃষি বিভাগের মাইকিংয়ের কারণে অনেকেই বোরো ধান কাটতে উৎসাহিত হচ্ছেন।
হাওড় অঞ্চলে বোরো আবাদ ॥ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসেব অনুযায়ী, এবছর হাওড়ভুক্ত ৭টি জেলা- কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বোরো আবাদ হয়েছে ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৫৩৪ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে শুধু হাওড়ে (সিলেট বিভাগের চার জেলার আওতাধীন হাওড় অঞ্চল) আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫১ হাজার ৭৭০ হেক্টর জমিতে। হাওড়ে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১৯ লাখ ৩০ হাজার টন। ২১ এপ্রিল পর্যন্ত হাওড়ভুক্ত ৭টি জেলায় ২ লাখ ৩১ হাজার ৩৬৫ হেক্টর জমির ধান কর্তন হয়েছে, যা শতকরা হিসাবে প্রায় ২৫ ভাগ। অন্যদিকে শুধু হাওড়ের ১ লাখ ৮০ হাজার ৭২৯ হেক্টর জমির ধান কর্তন হয়েছে, যা শতকরা হিসাবে প্রায় ৪০ ভাগ।
ধান কাটা শ্রমিক সঙ্কট ॥ গত বছরের মতো এবারও শ্রমিক-সঙ্কট ভাবাচ্ছে চাষীকে। যদিও কৃষি বিভাগ বলছে, দুশ্চিন্তার কারণ নেই। ফসল কাটতে বিতরণ করা হয়েছে পর্যাপ্ত ধান কাটার যন্ত্র। বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিকরা প্রত্যায়নপত্র নিয়ে দল বেঁধে ধান কাটতে যাচ্ছেন হাওড় অঞ্চলে।
সুনামগঞ্জের শতাধিক হাওড়েই বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। ১১ উপজেলার প্রতিটি হাওড়েই কমবেশি ধান কাটছেন কৃষক। গত ১ এপ্রিল কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক আনুষ্ঠানিকভাবে এ জেলায় ধান কাটার উদ্বোধন করেন। প্রশাসন ইতোমধ্যে ১০৭টি ধান কাটার যন্ত্র ভর্তুকিতে কৃষকদের দিয়েছে। সেই যন্ত্র দিয়েও অনেক স্থানে ধানকাটা চলছে।তবে কৃষকদের অনেকেই আবার শ্রমিক সঙ্কটের কথাও জানিয়েছেন। সরকারীভাবে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ধান কাটার জন্য শ্রমিক নিয়ে আসা হচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও লকডাউনের কারণে পর্যাপ্ত শ্রমকি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
কৃষকরা জানান, সুনামগঞ্জের শনির হাওড় অনেক বড় একটি হাওড়। বলা হয়ে থাকে, এই হাওড়ের ধান যদি ঠিকমতো ঘরে তোলা যায় তাহলে সারা বাংলাদেশের দুইদিনের চালের চাহিদা মেটানো যাবে। এতবড় হাওড়ের ধান কাটতে প্রতিবছর শ্রমিক সঙ্কটে ভোগান্তি পোহাতে হয় কৃষকদের। যদিও শ্রমিক সঙ্কট দূর করতে সরকার ধান কাটার যন্ত্র দিয়েছে। বিশেষ ব্যবস্থায় বাইরের জেলার শ্রমিককে নিয়ে আসা হচ্ছে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আবহাওয়া যদি আমাদের অনুকূলে থাকে তাহলে আগামী ৩০ তারিখের মধ্যে হাওড়ের সম্পূর্ণ ধান তারা কেটে ফেলতে পারব। কারণ ধান কাটার জন্য পর্যাপ্ত শ্রমিক এবং প্রতিটি হাওড়ের ধান কাটার মেশিন দেয়া হয়েছে। যদি হাওড়ের ধান কাটার জন্য আরও শ্রমিক প্রয়োজন হয় তাহলে তারা সেটারও ব্যবস্থা করে দেবেন বলে জানিয়েছেন।
হবিগঞ্জের কৃষকরা বলছেন, কামলার (শ্রমিক) অভাবে তারা ধান কাটতে পারছেন না। গ্রামের কামলার রোজার কারণে ধান কাটতে চায় না। আবার যারা কাটতে রাজি হন, তারা দৈনিক ৭০০ টাকা মজুরি চায়। হবিগঞ্জে বাইরে থেকেও এ বছর কোন শ্রমিক আসছে না। ফলে এ জেলার কৃষরা ধান কাটা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন।
তবে এ জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ তমিজ উদ্দিন বলছেন, অন্য বছর ধান কাটার শ্রমিক-সঙ্কট হলেও এ বছর তা হবে না। জেলায় স্থানীয় শ্রমিক রয়েছে ২০ হাজার ৫০০ জন এবং বাহির থেকে আনা হয়েছে ৬ হাজার ১০০ জন শ্রমিক। স্থানীয় ও বাইরের শ্রমিক মিলিয়ে ২৬ হাজার ৫০০ শ্রমিক রয়েছে। এ ছাড়া গেল বছর এবং চলতি বছর মিলিয়ে জেলায় ১০৩টি হারভেস্টর মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। যেগুলো পুরোদমে ধান কাটার কাজ করছে। এরপরও কেন কৃষকরা শ্রমিক-সঙ্কট বলে আমি বুঝতে পারছি না।
প্রত্যয়নপত্র নিয়ে ধান কাটতে যাচ্ছেন শ্রমিকরা ॥ বিভিন্ন জেলা থেকে হাওড় অঞ্চলসহ বোরো ধান উৎপাদন এলাকায় শ্রমিক যাচ্ছে ধান কাটার জন্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ধান কাটার জন্য যে সকল শ্রমিক যাচ্ছেন তাদের উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রত্যয়নপত্র দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে গত বছরের মতো এবছরও টাঙ্গাইল সিরাজগঞ্জ থেকে প্রচুর শ্রমিক প্রত্যায়নপত্র নিয়ে হাওড় অঞ্চলে গেছে ধান কাটতে।
গত মৌসুমের ন্যায় রাজশাহীর বাঘায় এবারও উপজেলা কৃষি অফিসারের কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে ধান কাটতে এলাকা ছাড়ছেন প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক। গত ১৭ এপ্রিল থেকে গ্রুপ ধরে শ্রমিকরা এলাকার বাইরে ধান কাটতে যাওয়া শুরু করেছেন।
গত মৌসুমেও ১৫-২০ জনের সমন্বয়ে এক একটি গ্রুপ গঠিত হয়। এভাবে গেল বছর প্রায় ২২ হাজার শ্রমিক ধান কাটতে বাইরে গিয়েছিলেন। চলতি মৌসুমেও ২০ হাজার শ্রমিক পর্যায়ক্রমে ধান কাটতে যাওয়ার জন্য এলাকা ছাড়তে শুরু করেছেন।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, ৬ হাজার শ্রমিক এরইমধ্যে আবেদন করে প্রত্যয়নপত্র নিয়েছেন। এসব শ্রমিকরা ধান কাটতে নাটোর, নওগাঁ, জয়পুরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া জেলার বিভিন্ন উপজেলায় যাচ্ছেন। শ্রমিকরা ভটভটিসহ বিভিন্ন যানবাহনে চড়ে যাচ্ছেন নিজ নিজ কর্মস্থলে।
জানা যায়, বোরো মৌসুমে এলাকায় কাজ না থাকায় প্রায় ২-৩ মাস বেকার সময় কাটাতে হয়। সংসার চালাতে গিয়ে অনেকে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অন্য এলাকায় এ সময় ধান কাটার জন্য শ্রমিক প্রয়োজন হয়। আর তাই বাসায় অলস বসে না থেকে ধান কেটে সংসার খরচ যোগাতে এলাকার বাইরে যান সবাই। ধান কাটা শেষে এক একজন শ্রমিক মজুরিসহ ২০-২৫ মণ ধান নিয়ে বাড়ি ফিরেন। এতে ভাতের অভাবও দূর হয় আবার অর্থ দিয়ে পরিশোধ হয় দেনা। গত মৌসুমে যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ থাকায় চুক্তিভিত্তিক গাড়ি ভাড়া করে গিয়েছিলেন তারা। আবার অনেকে বাইসাইকেল ও ভ্যান নিয়ে গিয়েছিলেন। এবারও যে যেভাবে পারছে যাচ্ছেন।
ধান উৎপাদিত এলাকায় প্রতিবছর এ সময় শ্রমিক সঙ্কট দেখা দেয়। এর সমাধানকল্পে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাসের মধ্যে প্রত্যয়নপত্র দিয়ে শ্রমিক পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। সেই ক্ষেত্রে উপজেলার নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার যৌথ স্বাক্ষরে প্রত্যয়নপত্র (অনুমতি) দেয়া হচ্ছে। এমনকি শ্রমিকবাহী গাড়ির চালকদেরও এ প্রত্যয়ন দেয়া হচ্ছে। যেহেতু শ্রমিকরা দলবদ্ধ হয়ে বাইরে গিয়ে কাজ করবে, সেহেতু কাজ শেষে ফেরার পর তাদের নমুনা পরীক্ষা করা হবে। যাদের মধ্যে করোনার উপসর্গ দেখা দেবে তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকারও নির্দেশনা দেয়া হবে। এছাড়াও প্রত্যেককে নিজেদের সাবধানতা অবলম্বন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, বেশি বেশি পানি পান করা ও ঘনঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার জন্যও পরামর্শ দিয়ে প্রত্যয়নপত্র দেয়া হচ্ছে।
উল্লেখ্য, সরকার ঘোষিত লকডাউনের সময় বোরা ধান কাটতে কৃষি শ্রমিক পরিবহনের বিষয়টি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জেলা প্রশাসকদের। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বোরো ধান কাটার জরুরী প্রয়োজনে কৃষিশ্রমিক পরিবহনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন সমন্বয় করবে।
দাম নিয়ে শঙ্কা ॥ ভাল ফলন হওয়ায় ধানের দাম নিয়েও শঙ্কায় রয়েছেন কৃষকরা। তারা বলছেন, যে বছরই ধানের ভাল ফলন হয় সেই বছরই ধানের দাম কম থাকে। গত বছর ধানের দাম বেশি থাকায় এবছর কৃষক বেশি জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছে। আবার অনুকূল আবহাওয়ায় ধানের ফলনও ভাল হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে ধান কাটা শেষ হবে। ফলে বেশি ধান বাজারে এলে দামের কী অবস্থা দাঁড়াবে তা নিয়ে শঙ্কায় আছে কৃষক।
হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার কাকাইলছেও এলাকার কৃষক মতিন মিয়া বলেন, ‘এ বছর ফলন ভাল হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখেছি যে বছর ধানের ভাল ফলন হয় এই বছর ধানের দাম কম থাকে। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে আমাদের কৃষকদের কথা মাথায় রেখে যেন ধানের দামটা ঠিক রাখা হয়।’
একই জেলার বানিয়াচং উপজেলার হারুনী গ্রামের কৃষক সুশীল দাস বলেন, ‘জমি করতে আমাদের অনেক কষ্ট হয়। আমাদের সারাবছরের পরিশ্রমের একমাত্র সম্ভল এই ধান। কিন্তু ধানের দাম যদি ঠিক না তাকে তহলে আমরা কীভাবে বাঁচমু। গেল কয়েক বছর ধরে বোরো চাষ করে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে আমরা যেন ধানের ন্যায্য দাম পাই।’
একই উপজেলার সুজাতপুর গ্রামের কৃষক মঈন উদ্দিন বলেন, শ্রমিকরা রোজার কারণে ধান কাটতে চায় না। যারা কাটতে রাজি হন, তারা আবার দৈনিক ৭০০ টাকা মজুরি চায়। এক কের ক্ষেতের ধান কাটতে লাগে ৫-৬ জন শ্রমিক। আর এক কের জমি থেকে ২০ মণ ধান পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘সরকার যদি ধানের দাম ঠিক রাখে তাহলে কিছুটা লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। না হলে আমাদের পথে বসা ছাড়া কোন গতি নাই।’
এ প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, গতবছর হাওড়ের ধান কাটার জন্য যেভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল, এ বছরও সেভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার আমরা দ্রুত ধান কাটার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলা থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রমিকদের নিয়ে আসা হয়েছে। এ মুহূর্তে হাওড়ে ধান কাটার জন্য শ্রমিকের কোন সঙ্কট নেই। পর্যাপ্ত শ্রমিক রয়েছে। একইসঙ্গে, কম্বাইন হারভেস্টর, রিপারসহ পর্যাপ্ত ধান কাটার যন্ত্র হাওড়ে এ বছর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যাতে কৃষক নির্বিঘ্নে ধান কাটার কাজ শেষ করতে পারে।
তিনি বলেন, ‘গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা হাওড় এলাকার ধান কাটার সব উদ্যোগ নিয়েছি। ধান কাটার জন্য টি-গার্ডেনগুলোর ম্যানেজারদের বলে আমরা টি-শ্রমিকদের ধান কাটার কাজে নিয়োজিত করেছি। বর্তমানে যে গতিতে ধান কাটা চলছে, তাতে আশা করছি এপ্রিলের মধ্যে হাওড়ের ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে।’
কৃষিমন্ত্রী আরও বলেন, অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে এবছর ধান চালের উৎপাদন বাড়াতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। আমাদের চেষ্টার কোন কমতি ছিল না। বেশি জমি চাষের আওতায় আনা, উন্নত জাতের ও হাইব্রিড জাতের ধান চাষে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। বীজ, সারসহ নানা প্রণোদনা কৃষকদের প্রদান করা হয়েছে। হাইব্রিড ধানের বীজ সহায়তা বাবদ ৭৬ কোটি টাকার প্রণোদনা কৃষকদের দেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এসব উদ্যোগের ফলে গত বছরের তুলনায় এবছর ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। একই সঙ্গে, গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমিতে হাইব্রিডের আবাদ বেড়েছে। আশা করা যায়, গত বছরের তুলনায় এবছর বোরোতে ৯- ১০ লাখ টন বেশি উৎপাদন হবে।
মোট বোরো আবাদ ॥ এ বছর সারাদেশে বোরোতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৮ লাখ ৫ হাজার ২০০ হেক্টর, আবাদ হয়েছে ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৮৩ হাজার হেক্টর বেশি। সেই সঙ্গে উৎপাদন বাড়াতে হাইব্রিড জাতের ধানের আবাদে জোর দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে হাইব্রিড ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১১ লাখ ৪ হাজার ৬৩৩ হেক্টর, আবাদ হয়েছে ১২ লাখ ১৩ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে। কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে হাইব্রিডের আবাদ বেড়েছে। গড়ে হেক্টর প্রতি ১ টন করে বেশি ফলন হলেও কমপক্ষে ৩ লাখ টন উৎপাদন বাড়বে।