অজয় দাশগুপ্তঃ
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ব্যাপক, গভীরতায় অতল। এর পুরোটা জুড়েই সম্মুখ সারিতে থাকা একটি নাম- শেখ মুজিবুর রহমান। তরুণ বয়সেই ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতি-সাহিত্য প্রশ্নে পাকিস্তানি শাসকদের কু-মতলব এবং বাঙালিদের আবেগ ও রোষ-ক্ষোভ ধরে উঠতে পারেন। ততদিনে আন্দোলনের বর্ষাফলকও তাঁর হাতেই তৈরি- ছাত্রলীগ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র সাড়ে চার মাসের মধ্যেই ছাত্র-জনতার স্বপ্ন-সাহসের প্রতিচ্ছবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তাঁর নিপুণ হাতের ছোঁয়ায়, অনন্য এ প্রতিষ্ঠান। এক মাসের মধ্যে পূর্ব বাংলার সব জেলায় তিনি এ সংগঠন ছড়িয়ে দিতে পারেন।
এ সংগঠন প্রতিষ্ঠার দুই মাস যেতে না যেতেই আসে বড় চ্যালেঞ্জ- ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবসে ডাকা ১১ মার্চে হরতাল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম বড় ধরনের প্রতিবাদী আন্দোলন সফল করে তোলায় শেখ মুজিব কেবল ছাত্রলীগ কর্মীদের নয়, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদেরও রাজপথে নামিয়ে আনতে পারেন। আর নিজে থাকেন সামনের সারিতে। হরতালের সমর্থনে প্রচার অভিযানে তিনি জেলায় জেলায় ঘুরেছেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ঐ তারিখের তিন দিন পূর্বে ঢাকা ফিরে এলাম।’ [পৃষ্ঠা ৯২] হরতালের দিনে ছাত্রদের সঙ্গে নিজেও নেমে পড়েন রাজপথে। পিকেটিংয়ের সময়েই সচিবালয়ের সামনে থেকে গ্রেফতার হলেন তিনি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম জেলজীবন তাঁর। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের প্রথ খণ্ডে বলা হয়েছে- ‘১১ মার্চ (১৯৪৮) শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করার প্রতিবাদে ১৬ মার্চ গোপালগঞ্জে সর্বাত্মক হরতাল আহ্বান করা হয়। এস এন অ্যাকাডেমি ও এম এন ইনস্টিটিউশনের প্রায় ৪ শ’ ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে মিছিল বের করে।’
জেল থেকে মুক্ত হয়েই শেখ মুজিব নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন আন্দোলনে। কয়েকদিন পর কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ রেস কোর্স ময়দানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দিলে তিনি আরও অনেকের সঙ্গে প্রতিবাদ করেন। এরপর যে সব স্থানে তিনি সভা-সমাবেশ করেছেন, সর্বত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সামনে আনেন। একইসঙ্গে জোর দেন শিক্ষার প্রসারের ওপর। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৪৮ সালের ১ জুন নরসিংদী ঈদগাহ ময়দানে তিনি বলেন, মুসলিম লীগ সরকার চায় না যে জনগণ শিক্ষিত হয়ে উঠুক। তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষকদের ৭ মাস বেতন বাকি। অন্যদিকে, পদস্থ সরকারি অফিসারদের বেতন দেওয়া হচ্ছে নিয়মিত। তিনি বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার দাবি জানান। [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা ২৪]
১ ডিসেম্বর খুলনার দৌলতপুর কলেজের ছাত্রসমাবেশে তিনি লেখাপড়ার প্রতি বিশেষ জোর দিয়ে বলেন, ‘আপনারা ছাত্র হিসাবে ভাল হইতে চেষ্টা করুন। আপনারা শিক্ষায় প্রত্যেকটি শাখায় পারদর্শী হউন।’ [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা ৫৬-৫৭]
১৯৪৯ সালে দুই বার তিনি গ্রেফতার হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গরিব কর্মচারীদের আন্দোলন সমর্থনের কারণে ছাত্রত্ব চলে যায় তাঁর। সমাপ্তি ঘটে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের। কিন্তু বাস্তব জীবনের পাঠ যে নিয়েছেন তিনি। কে রুখবে তাকে? জেলে থেকেই নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। মুক্ত হয়ে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে নব উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
ছাত্রলীগের কোনো কমিটিতে না থাকলেও এই সময়ে ছাত্র আন্দোলনে তাঁর প্রভাব বোঝার জন্য দুটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। ১১ মার্চ (১৯৪৮) হরতালের সময় তিনি গ্রেফতার হন। তার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসবেন। এ সময়ে শেখ মুজিবের মতো প্রভাবশালী ছাত্রনেতাসহ বিপুল সংখ্যক ছাত্র ভাষা ইস্যুতে জেলে থাকাটা খাজা নাজিমুদ্দীন সরকারের জন্য অস্বস্তির কারণ ছিল। এ কারণে সরকার ছাত্র নেতাদের সঙ্গে ভাষা প্রশ্নে চুক্তি সম্পাদন করে। এই চুক্তির খসড়া শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক (আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক) ও অলি আহাদসহ অন্যদের দেখানোর জন্য কামরুদ্দিন আহমদকে জেলখানায় পাঠানো হয়। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে কামরুদ্দিন সাহেব জেলে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বললেন, নাজিমুদ্দীন সাহেব এই দাবিগুলি মানতে রাজী হয়েছেন; এখনই পূর্ব পাকিস্তানের অফিসিয়াল ভাষা বাংলা করে ফেলবে। পূর্ব পাকিস্তান আইনসভা থেকে সুপারিশ করবেন, যাতে কেন্দ্রে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হয়। সমস্ত মামলা উঠিয়ে নিবেন, বন্দিদের মুক্তি দিবেন। [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পুষ্ঠা ৯৩]
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের প্রথম খণ্ডে ২০ এপ্রিলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারিদের আন্দোলনের প্রধান ‘উস্কানিদাতাদের’ মধ্যে রয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমা চেয়ে মুচলেকা দিলে তাঁর ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং জেল থেকে মুক্তি মিলবে। এ প্রস্তাব দিয়ে ৯ মে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরীকে পাঠানো হয় শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। কিন্তু তিনি ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করেন এবং বলেন, ছাত্ররা কোনো অন্যায় করেনি। [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা ১৫৫-১৫৭]
এবার জেলে থাকার সময় ২৩ জুন গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি নির্বাচিত করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। দুই মাসের বেশি জেল খেটে ২৬ জুন তিনি মুক্তিলাভ করেন। সে দিন জেল গেটে বিপুল সংখ্যক কর্মীসহ ফুলের মালা নিয়ে উপস্থিত ছিলেন দলের সভাপতি মওলানা আদুল হামিদ খান ভাসানী। মুক্তির পর শেখ মুজিবুর রহমানকে মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা ২০২]
দলের জন্য তিনি কতটা অপরিহার্য গণ্য হচ্ছেন, এ ঘটনা তার একটি নজির।
বঙ্গবন্ধু ফের গ্রেফতার হন ১৯৪৯ সালের শেষ দিনে। ১১ অক্টোবর (১৯৪৯) আরমানিটোলা ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভা শেষে মিছিলে পুলিশের হামলা হয়। কিন্তু মামলা হয় আওয়ামী লীগ সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদকের নামে। মামলায় তিন মানের জেল হয় কেবল যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের। অন্যরা খালাস পায়। তবে দণ্ড ভোগের পরও বিনাবিচারে আটক রাখা হয় ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এক জেল থেকে আরেক জেলে কেটে যায় দীর্ঘ সময়। কিন্তু জীবন নিবেদিত যার মুক্তির সংগ্রামে, যে কোনো পরিবেশেই তিনি সক্রিয়। অন্য সবার জন্য প্রেরণা। কারাগারে সহবন্দিদের প্রেরণা দেন। স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে বলেন, বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি-সভ্যতা-সংস্কৃতি সব শেষ হয়ে যাবে। স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবও প্রেরণা দিয়ে স্বামীকে বলেন- জেলে থাক আপত্তি নেই- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।
এই দফা জেলে থাকার সময়েই রচিত হয় অমর একুশের বীরত্ব গাঁথা। এ সময়ের ঘটনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষ্য এবং গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বিবরণ প্রায় হুবহু মিলে যায়।
জেলে থাকার সময় মামলার তারিখগুলোতে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা দেখা করতে আসত। [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১৬৯]
জেলে তিনি ফুলের বাগান করেছিলেন। এতে প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকতে পারতেন, সময়ও কাটাত। একই সঙ্গে আমরা তাঁর রোমান্টিক ও মানবিক গুণের পরিচয় পাই। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যেদিন হক সাহেবের (আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক) সাথে তাঁর বেগম সাহেবা দেখা করতে আসতেন…তাদের দেখা হবার দিনে ফুল তুলে হয় ফুলের মালা, না হয় তোড়া বানিয়ে দিতাম।’ [পৃষ্ঠা ১৬৯]
কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে কী সংযমী! তাঁর বয়স ৩০ বছর, স্ত্রীর বয়স ২০ বছর, গ্রামের বাড়িতে রয়েছে ৩ বছর বয়সী কন্যা শেখ হাসিনা ও কয়েক মাস বয়সী পুত্র শেখ কামাল। ১৯৫০ সালের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধুকে গোপালগঞ্জ আদালতে এক মামলায় হাজিরা দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল খুলনাগামী স্টিমারে। একই দিনে বেগম মুজিব দুই সন্তান ও শ্বশুরকে নিয়ে স্টিমারে চলেছেন ঢাকা, স্বামীর সঙ্গে কারাগারে দেখা করতে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘এক জাহাজে আমি এসেছি। আর এক জাহাজে ওরা ঢাকা গিয়েছে। দুই জাহাজের দেখাও হয়েছে একই নদীতে। শুধু দেখা হল না আমাদের। এক বৎসর দেখি না ওদের। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল।’ [ অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃষ্ঠা ১৭৬]
১৯৪৯ সালের শেষ দিন গ্রেফতার হওয়ার পর এক পর্যায়ে শেখ মুজিব অসুস্থ হলে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকায় পল্টনের জনসভায় ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ সকলেই এর প্রতিবাদ করল। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। আমি ওদের রাত একটার পর আসতে বললাম। আরও বললাম, খালেক নেওযাজ, কাজী গোলাম মাহবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন পিছনের বারান্দা দিয়ে ওরা পাঁচ-সাতজন এসেছে।… আমি বললাম সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে।… ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠন। ছাত্রলীগ নেতারা রাজী হল। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজী হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃষ্ঠা ১৯৬]
বঙ্গবন্ধু ছাত্র নেতাদের বলেন, ‘খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এস। আরও দু’একজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বললাম।… পরের দিন একে একে অনেকে আসল। সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১ শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। আমি আরও বললাম, আমিও আমার মুক্তির দাবি করে ১৬ ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করব। আমার ছাব্বিশ মাস জেল হয়ে গেছে।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃষ্ঠা ১৯৭]
এখন দেখা যাক গোয়েন্দা প্রতিবেদন কী বলছে। ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘নিরাপত্তাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান, যাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা আনা হয়েছে- তিনি taking undue advantage of his coming to Dacca in furtherance of his political activity. This is indeed a misuse of a favour.’ [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, দ্বিতীয় খণ্ড পৃষ্ঠা ১৩৭]
একই গ্রন্থের ১৪০ পৃষ্ঠায় ২০ ফেব্রুয়ারির গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদ অনশন কর্মসূচি পালনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সে বিষয়ে লিফলেট প্রকাশিত হয়েছে এবং ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে তা বিলি হচ্ছে।
অনশন ধর্মঘট পালন করার সিদ্ধান্ত জানার পর মুসলিম লীগ সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের মতো জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাকে ঢাকায় রাখা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেছে। এ কারণে ১৫ ফেব্রুয়ারি মহিউদ্দিন আহমদ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে ফরিদপুর জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাদের স্টিমার ছিল নারায়ণগঞ্জ থেকে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধু নারায়ণগঞ্জের ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করেন। [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১৯৯]
নারায়ণগঞ্জ থেকে ফরিদপুর জেলে যেতে একদিনের বেশি লেগে যাবে। এ সময় অনশন করলে দেশবাসী জানবে না। তাই স্টিমারে থাকার সময়েই বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিলেন- ‘জাহাজে অনশন করি কি করে? আমাদের জেলে নিতে হবে অনশন শুরু করার পূর্বে। সমস্ত দিন জাহাজ চলল, রাতে গোয়ালন্দ ঘাটে এলাম। সেখান থেকে রাত চারটায় ফরিদপুর পৌঁছালাম।…ফরিদপুরের সহকর্মীরা জানতে পারবে, আমরা ফদিপুর জেলে আছি এবং অনশন ধর্মঘট করছি।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২০০-২০১]
অনশন পালন যাতে না করতে পারেন, সে জন্য তাদের জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ব্যর্থ হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণ ও সালাম-বরকত-রফিক-শফিকের মহান আত্মদানের খবর সেখানেই শোনেন। ফরিদপুরের হরতাল এবং ছাত্র-জনতার মিছিল-সমাবেশের খবর পাচ্ছিলেন। মিছিলের স্লোগান কানে আসছিল- শেখ মুজিবের মুক্তি চাই। তাদের স্বাস্থ্যের গুরুতর অবনতি ঘটতে থাকে। এ দিকে ঢাকায় গুলি করে ছাত্র হত্যার প্রতিক্রিয়ায় গোটা পূর্ব বাংলা অতিগ্নগর্ভ হয়ে ওঠে। দিনের পর দিন হরতাল চলতে থাকে। এ অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানের মত জনপ্রিয় নেতার অনশনে মৃত্যু ঘটলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বুঝতে পেরে তাকে ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি দেওয়া হয়। তিনি চলে যান টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে। শিশু কন্যা শেখ হাসিনার মুখে শোনেন স্লোগান- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। পুলিশের গুলির জবাব চাই।
মহিউদ্দিন আহমদ মুক্তি পান দুই দিন পর।
১ মার্চ ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জ প্রশাসন ও পুলিশের কাছে টেলিগ্রাম যায়- শেখ মুজিবের প্রতি সর্বক্ষণ নজর রাখ। যদি তিনি বেআইনি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন, অবশ্যই গ্রেফতার করতে হবে। [গোয়েন্দা প্রতিবেদন দ্বিতীয় খণ্ড পৃষ্ঠা ১৪৬]
টানা দুই বছরের বেশি জেল এবং অনশনে ক্লান্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু দেশের জন্য ব্যক্তিগত কষ্ট-যন্ত্রণা উপেক্ষা করাই যে তাঁর ব্রত। ঢাকায় এসেই নতুন দায়িত্ব- প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। এ সময় পূর্ব বাংলায় ভাষা আন্দোলন নতুন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নতুন দায়িত্ব নিয়ে যান পশ্চিম পাকিস্তান সফরে- সেখানে শাসকরা যে অপপ্রচার-বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে, তা দূর করা। ২১ মে তিনি পাকিস্তানের রাজধানী করাচি যান। সেখানে রাজনৈতিক মহল ও সমাজের বিভিন্ন অংশের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলন করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভা নির্বাচন, বন্দিমুক্তির দাবি সামনে আনেন। ১৪ জুন করাচি থেকে হায়দ্রাবাদে অবস্থিত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে চিঠি লেখেন, ‘Please don’t think for me. I have born to suffer.’ [গোয়েন্দা প্রতিবেদন দ্বিতীয় খণ্ড পৃষ্ঠা ২৩৯]
ঢাকায় ফিরে ফের কর্মব্যস্ত জীবন। বাংলার পথে-প্রান্তরে ঘুরতে থাকেন মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্য সামনে রেখে। বছরের বছর স্বায়ত্তশাসনের দাবি সামনে আনেন। মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব পাকিস্তানের স্কুলগুলোতে উর্দু শেখানোর পাঁয়তারা করলে তিনি ঘোষণা দেন- পশ্চিম পাকিস্তানের সব স্কুলে বাংলা শেখানো না হলে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু শেখানো বন্ধ করে দেব।
ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন বঙ্গবন্ধু। সরাসরি স্বাধীনতার ডাক দেন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ।
স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা স্বীকৃত হয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে প্রথম বাংলায় ভাষণ দেন। এই বিশ্ব সংস্থাই বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে সাড়া দিয়ে অমর ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এখন বিশ্বের দুই শতাধিক দেশে পালিত হয় এ মহান দিবস। শত শত কোটি মানুষের কণ্ঠে আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…। বিশ্ববাসী স্মরণ করে বাংলাদেশের ভাষা শহীদদের, শ্রদ্ধা জানায় এই আন্দোলনের বীর নায়কদের। বিশেষভাবে তাদের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে একটি নাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় যে মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম- তার অবিসংবাদিত নেতাও তো তিনি।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু