নৈতিক স্খলনের দায়ে চাকরীচ্যুত সেনা অফিসার শহিদ উদ্দিন খান ও তার স্ত্রী ফারজানা আনজুম ব্রিটেনে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। তথ্যসূত্র বলছে, কয়েকমাস আগে হঠাৎ করেই বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শহিদ উদ্দিন খান কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ করে স্থায়ী আবাসন নেন ব্রিটেনে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের সাবেক এই সেনা অফিসারের নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র বেশ কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন অপরাধে সক্রিয়। জঙ্গি অর্থায়ন, অস্ত্র ব্যবসা, জালিয়াতি, প্রতারণা, অর্থ পাচার, নানা অপকর্মসহ সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তির জাল দলিল তৈরিসহ কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। যা সরাসরি ব্যবহার হচ্ছে জঙ্গি অর্থায়নের মতো ভয়ংকর কাজে।
এ যাবৎকালে শহিদ উদ্দিন খান ও তার সংঘবদ্ধ চক্রের দ্বারা সংঘটিত অপরাধসমূহ তুলে ধরা হলো-
জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা: চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি গোপন তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের চৌকস একটি টিম ঢাকার বারিধারা ডিওএইচএস এলাকাস্থ বাড়ী নং ১৮৪, সড়ক নং ২ এর একটি ফ্ল্যাট এ অভিযান চালিয়ে ২টি বিদেশি পিস্তল, ১১ রাউন্ড পিস্তলের গুলি, ম্যাগাজিনসহ ২টি শটগান, ২টি শটগানের কার্তুজ, ৫০টি ডেটোনেটরসহ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটকে (আইএস) অনুসরণ সংক্রান্ত বিপুল সংখ্যক জিহাদি বই উদ্ধার করে। এসবের সঙ্গে শহিদ উদ্দিন খান ও তার পরিবারের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার তথ্য ও প্রমাণ মিলেছে।
১৫ বছর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জে তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এ কর্মরত থাকাকালে দুর্নীতির দায়ে তিনি চাকরীচ্যুত হন। চাকরীচ্যুত হওয়ার পর শহিদ উদ্দিন খান পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র এজেন্ট জনৈক সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে মিলে সেনা কর্মকর্তার মিথ্যা পরিচয় দিয়ে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। গাইবান্ধা জেলার বাসিন্দা সাজ্জাদ হোসেন ছাত্রজীবনে নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় ক্যাডার ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সেনাশাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের ছাত্র সমাজে যোগ দেন।
শহিদ উদ্দিন খানের আরো অপকর্ম: ১/১১ পরবর্তী সময়ে শহিদ উদ্দিন খান এবং আইএসআই এজেন্ট সাজ্জাদ হোসেন মিলে বাংলাদেশ পারসস্পেক্টিভ রিসার্চ ফোরাম (বিপিআরএফ) প্রতিষ্ঠা করেন। যেটির চেয়ারম্যান করা হয় জামায়াত ঘরানার অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহকে। এই সংগঠনটির কাজ ছিলো আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সম্পর্কে কাল্পনিক অভিযোগ সাজানো। এর পাশাপাশি বিপিআরএফ সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ব্ল্যাক মেইলিংয়ের মাধ্যমে টাকা আদায় করতো। এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শহিদ উদ্দিন খান এবং সাজ্জাদ হোসেন বিপুল অংকের অর্থ হাতিয়ে নেন।
শহিদ উদ্দিন খান এবং সাজ্জাদ হোসেন মিলে জজকোর্টের কিছু টাউট গোছের আইনজীবীর সমন্বয়ে একটি জালিয়াতি চক্রও গড়ে তোলেন। এই জালিয়াতি চক্রের অন্যতম সদস্য অ্যাডভোকেট গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক এবং আয়কর আইনজীবী নজরুল ইসলাম। এই অপরাধ সিন্ডিকেটটি জমির জাল দলিল তৈরির পাশাপাশি সাজ্জাদ হোসেনের মাধ্যমে পাকিস্তানি আইএসআই কর্তৃক সরবরাহকৃত জাল টাকার ব্যবসায় জড়িত হয়। চক্রটি প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা মূল্যের বাংলাদেশি জালটাকা বাজারে ছড়িয়েছে বলেও অভিযোগ আছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ২০০৯ সালে শহিদ উদ্দিন খান তার স্ত্রী ফারজানা আনজুমের নামে ব্রিটেনে বিনিয়োগ ক্যাটাগরিতে ইমিগ্রেশনের আবেদন করেন। আশ্চর্যজনকভাবে, ব্রিটিশ সরকার শহিদ উদ্দিন খানের স্ত্রী ফারজানা আনজুম কর্তৃক বিনিয়োগকৃত বিশাল অংকের কালো টাকা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করে, যা স্পষ্টভাবেই মুদ্রা পাচারের আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। ২০১১ সালে শহিদ উদ্দিন খানের অন্যতম সহযোগী সাজ্জাদ হোসেন তার স্ত্রী এবং একমাত্র ছেলেসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের আবেদন করেন।
এছাড়া কয়েক বছর ধরেই শহিদ উদ্দিন খান ব্রিটেনে বসবাস করছেন। অপরদিকে সাজ্জাদ হোসেন থাকছেন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টোনে। অভিযোগ আছে, ব্রিটেনে বসে শহিদ উদ্দিন খান জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটকে নিয়মিত আর্থিক সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি সেখানকার তরুণ-তরুণীদের আইএস’এ অন্তর্ভুক্ত করার কাজ করছেন। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে বসে সাজ্জাদ হোসেন নানা ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপে মদদ যোগাচ্ছেন।
ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র দাবি করেছে, ইসলামিক স্টেটের সামরিক শাখার একজন অন্যতম সদস্য হলেন চাকরীচ্যুত এই সেনা কর্মকর্তা। তিনি আইএস’এর হয়ে আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাচালান সিন্ডিকেটের কাছ থেকে এই ভয়ংকর জঙ্গি গোষ্ঠীর জন্য অস্ত্র এবং বিস্ফোরক সংগ্রহের কাজটিও করছেন এমন অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও শহিদ উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি দেশটি।
২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি শহিদ উদ্দিন খানের ঢাকার বারিধারা ডিওএইচএস এর বাসায় অভিযান চালানোর পর তার জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি প্রমাণ হলেও সিটিটিসি টিমটি ওই বাড়ী থেকে আরো কিছু স্পর্শকাতর কাগজপত্র উদ্ধার করে। যা ব্রিটেনের সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার সাথেও শহিদ উদ্দিন খানের প্রত্যক্ষ জড়িত থাকার বিষয়গুলো প্রমাণ করে। তবে সব নথি উদ্ধার করা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, এসব আলামত শহিদ উদ্দিন খানের দেহরক্ষী আকিদুল কিংবা তার প্রতারক চক্রের অন্যতম সদস্য নজরুল ইসলামের কাছে থাকতে পারে।
শহিদ উদ্দিন খানের ঢাকার বাসায় সিটিটিসি টিমের অভিযানের খবর জানার পর থেকেই শহিদ উদ্দিন খান এবং তার সহযোগী সাজ্জাদ হোসেন যথাক্রমে ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নজরুল ইসলামসহ কিছু সেনা এবং পুলিশ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে বারিধারার ওই বাড়ীটিতে অভিযান এবং পরবর্তীতে দায়ের হওয়া মামলা সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, অভিযানের ফলে শহিদ উদ্দিন খান এবং সাজ্জাদ হোসেন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
এদিকে সিটিটিসি সূত্র থেকে জানা গেছে, জঙ্গি অর্থায়নকারী শহিদ উদ্দিন খানের নেটওয়ার্কসহ বাংলাদেশে তার অন্য সহযোগীদের বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হওয়ার পর শহিদ উদ্দিন খানকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে শিগগিরই উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানা গেছে। এছাড়া বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নসহ (র্যাব) বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওয়েবসাইটে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় শহিদ উদ্দিন খানের নাম ও ছবি প্রকাশের প্রক্রিয়া চলছে।
দুই বরখাস্ত সেনা অফিসারের যোগাযোগ ও অপকর্ম: ব্রিটেনে বসে চাকরীচ্যুত সেনা কর্মকর্তা শহিদ উদ্দিন খান পাকিস্তানে অবস্থানরত আরেক চাকরীচ্যুত সেনা অফিসারের সাথে যোগাযোগ রাখছেন বলে অভিযোগ আছে। বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থানকারী সাবেক সেনা অফিসার মেজর (বরখাস্ত) জিয়া বাংলাদেশে সক্রিয় আনসার আল ইসলাম নামের জঙ্গি সংগঠনের নেতা। ইতিপূর্বে তিনি বাংলাদেশে একাধিক নাশকতার চেষ্টার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। ভয়ংকর এই জঙ্গি নেতার সাথে শহিদ উদ্দিন খান কেবল যোগাযোগই রাখছেন না বরং এরা সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশে নাশকতা চালানোর ছক আঁকছেন বলেও গণমাধ্যমের খবরে দাবি করা হয়েছে।
ব্রিটেনে শহিদ উদ্দিন খানের অপতৎপরতা: প্রতারণা, জালিয়াতি, অর্থ পাচার, অস্ত্র ব্যবসা এবং জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগে শহিদ উদ্দিন খানসহ তার নেতৃত্বাধীন অপরাধ চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে একাধিক গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলছে। গ্রেফতার এড়াতে বাংলাদেশে শহিদ উদ্দিন খানের সহযোগীরা গা ঢাকা দিয়েছেন। অন্যদিকে, ব্রিটেনে বসে চাকরীচ্যুত এই সেনা অফিসার সংবাদমাধ্যম কর্মীদের নানাভাবে বিভ্রান্ত করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এরই মধ্যে এই জঙ্গি অর্থায়নকারীর পক্ষে কাজ করছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। জানা গেছে, ডেভিডকে মোটা অংকের মাসোয়ারায় নিয়োগ দিয়েছেন শহিদ উদ্দিন খান।