পদ্মা সেতু হচ্ছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের একটি স্বপ্ন। দিন যত গড়াচ্ছে স্বপ্নটাও তত বাস্তব হয়ে উঠছে। আর মাত্র ১৫ মাসের অপেক্ষা। তারপর পুরোপুরি ডানা মেলবে এ স্বপ্ন। এর মধ্য দিয়ে দূরত্ব কমে যাবে এক অঞ্চলের সঙ্গে আরেক অঞ্চলের। অর্থনীতির চাকা ঘুরবে দ্রুতবেগে। বাড়বে জীবনযাত্রার মান। পদ্মার বুক চিরে যার এক প্রান্ত ছুঁয়ে থাকবে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া, অন্য প্রান্ত শরীয়তপুরের জাজিরা। পদ্মার বুকে যে স্বপ্নের যাত্রা হয়েছিল তা এখন বাস্তবের কাছাকাছি। প্রতিদিন ৬ থেকে ৭ হাজার শ্রমিক এ স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে ঘাম ঝরাচ্ছেন। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পসূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে মূল সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ। পদ্মা সেতু দাঁড়িয়ে থাকবে ৪২ পিয়ার (পিলার) বা স্তম্ভের মধ্যে; যার মধ্যে সম্পূর্ণভাবে নির্মাণ হয়ে গেছে ৩৯টি। বাকি ৩টির মধ্যে ১০ ও ২৭ নম্বর পিয়ারের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ ২টি মার্চের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। শুধু ২৬ নম্বর পিয়ারের নির্মাণকাজ শেষ হবে এপ্রিলের মধ্যে। এ ছাড়া ৮ নম্বর পিয়ারের কাজ শেষে এখন ক্যাপ ঢালাই চলছে। এটি সিঙ্গেল ক্যাপ। পদ্মা সেতুর ৭, ১৩, ১৯, ২৫, ৩১ ও ৩৭ নম্বর পিয়ার ছাড়া বাকি সব সিঙ্গেল ক্যাপে। প্রকল্পসূত্র জানান, পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ৪১টি স্প্যান বসবে। এর মধ্যে ২৫টি স্প্যান ইতিমধ্যে বসে গেছে; যার মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতু অর্ধেকের বেশি দৃশ্যমান। বাকি আছে ১৬টি স্প্যান। এর মধ্যে আগামী ১০ মার্চ বসবে আরও ১টি স্প্যান। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, জুলাইয়ের মধ্যেই পিয়ারের ওপর সব স্প্যান বসিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। সরেজমিন দেখা গেছে, সেতুর মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে ১৩ থেকে ১৯ নম্বর পিয়ার পর্যন্ত ৬টি স্প্যান বসানো। আর ওপারে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ৩০ থেকে ৪২ নম্বর পিয়ার পর্যন্ত একাধারে ১৩টি স্প্যান বসানো। এ ছাড়া মাওয়া প্রান্তে ট্রাস্ট ফেব্রকেশন ইয়ার্ডের ভিতরে প্রস্তুত রয়েছে আরও ২টি স্প্যান। অ্যাসেম্বলিং করা হয়েছে আরও ৩টি। বাকিগুলো ওয়েল্ডিং পর্যায়ে রয়েছে।
এ ছাড়া আরও ২টি স্প্যানের যন্ত্রাংশ চীন থেকে আসার অপেক্ষা করা হচ্ছে। শুধু পিয়ার তুলে আর স্প্যান বসিয়েই সেতুর কাজ অর্ধেকের বেশি হয়ে গেছে এমন নয়। সেতুর একটা অংশে রেল স্ল্যাব ও সড়ক স্ল্যাব বসানোর কাজও চলছে পুরোদমে। জাজিরা প্রান্তে সেতুর ওপরে উঠে দেখা গেছে, সড়ক ও রেলপথ- দুই স্তরেই স্ল্যাব বসানোর কাজ চলছে। দেশি-বিদেশি শ্রমিকরা ভারী যন্ত্রপাতির মাধ্যমে রাতদিন সমানে স্ল্যাব বসানোর কাজ করছেন। ইতিমধ্যে সড়কপথের জন্য জাজিরা প্রান্তে ৩১৬টি রোড স্ল্যাব বসানোর কাজ হয়ে গেছে। সেতুর ওপরে সড়কভাগে স্ল্যাব বসবে মোট ২ হাজার ৯১৭টি। এর মধ্যে ২ হাজার ৩৮২টি স্ল্যাব প্রস্তুত হয়ে গেছে। এখন বাকি আছে ৫৩৫টি স্ল্যাব তৈরির কাজ। সেতুর রেলপথে বসবে মোট ২ হাজার ৯৫৯টি স্ল্যাব; যার সবই ইতিমধ্যে প্রস্তুত করা হয়ে গেছে। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত জাজিরা প্রান্তে স্ল্যাব বসানো হয়েছে ৬১৪টি। এ স্ল্যাবের ওপর বসবে রেলের পাটাতন ও রেললাইন।
প্রকল্পসূত্র জানান, খুব শিগগির একসঙ্গে ৪টি টিম স্ল্যাব বসানোর কাজ শুরু করবে। তখন অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩০-৩২টি স্ল্যাব বসানো যাবে। এতে কাজের গতি বেড়ে যাবে। ২০২১ সালের ৩০ জুনের মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সড়ক অংশের কাজ পুরোপুরি শেষ করে যান চলার জন্য খুলে দেওয়া যাবে। এখন এটাই কাজ শেষ করার সময়সীমা। তবে প্রকল্পের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছেন, যদি কিছুটা সময় বেশি লাগে তাহলে তারা সেটা ব্যয় করবেন। কোনোভাবেই কাজের মানের প্রশ্নে আপস করবেন না। এদিকে প্রকল্পসূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত চীনা শ্রমিকের মধ্যে ১২৮ জন এখনো চীনে কোয়ারেনটাইনে রয়েছেন। তারা কবে আসবেন এ নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়ে গেছে।
সেতুসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এই শ্রমিকদের ফিরে আসার বিলম্বের কারণে কাজের গতি কিছুটা ধীর হতে পারে। প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পদ্মায় সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেতু নির্মাণের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত জাপানি অর্থ সহায়ক সংস্থা (জাইকা) সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করে। ওই সময়ই ২০০১ সালের ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ওপর সেতু নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন; যার মধ্য দিয়ে সেতু নির্মাণের বীজ বপন করা হয়। মাঝখানের আট বছর খুব একটা অগ্রগতি না হলেও ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত হয় নকশা চূড়ান্তকরণের কাজ। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে নিজস্ব অর্থায়নে পুরোদমে শুরু হয় কাজ।