আবদুল মান্নানঃ
২০২১ সালের ২৬ মার্চ ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ তার সুবর্ণজয়ন্তীতে পদার্পণ করছে। শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ। এই মাহেন্দ্রক্ষণে স্মরণ করি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বিনীত চিত্তে শ্রদ্ধা জানাই সেই ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর তিন লক্ষ মা বোনকে, যাদের রক্ত ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের এই বাংলাদেশ। আমাদের প্রজন্মের আর একটি পঞ্চাশ বছর উদযাপন করার বা দেখার কোনও সম্ভাবনা নেই। বর্তমান প্রজন্মের জন্য কিছু স্মৃতি লিখে রেখে যেতে চাই, যাতে তারা বুঝতে পারেন কেমন ছিল সে দিনের বাংলাদেশ আর বর্তমান বাংলাদেশে পৌঁছাতে কত দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরলেন। ইয়াহিয়া খান তাঁর ফাঁসির সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। এরইমধ্যে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ও ভারতের মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে গণহত্যার মূল নায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খান আর এক খলনায়ক পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলি ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন ২০ ডিসেম্বর। ভুট্টো তখনও অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখছিলেন। দায়িত্ব নিয়েই তিনি ঘোষণা করেন ‘শেখ মুজিবকে প্রাণদণ্ড দিলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা আর দেশে ফিরতে পারবে না’। এই সময় পাকিস্তানের প্রায় নব্বই হাজার সৈন্য বাংলাদেশে যুদ্ধবন্দি হিসেবে অবস্থান করছিল। পর দিন একই ভুট্টো ঘোষণা করেন ‘শেখ মুজিবকে শিগগিরই জেল থেকে মুক্তি দিয়ে অন্য কোথাও গৃহবন্দি করা হবে’। এদিকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছিল। সেই চাপের মুখে ও বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুকে ভুট্টো ১৯৭২ সালে ৮ জানুয়ারি মুক্তি দিতে বাধ্য হন। লন্ডন হয়ে তিনি ১০ জানুয়ারি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। একদিন বিরতি দিয়ে ১২ তারিখ বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা হতে সংসদীয় গণতন্ত্রে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটে। দায়িত্ব গ্রহণ করেই উপলব্ধি করেন তিনি একটি সম্পূর্ণ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন। যে দিকেই তিনি নজর দেন তিনি দেখেন এক বিশাল শূন্যতা। খাদ্য গুদামে এক ছটাক চাল নেই। ব্যাংকে একটি টাকাও নেই। ভারত থেকে এক কোটি শরণার্থী দেশে ফিরছে। দেশের অভ্যন্তরে প্রায় সমান সংখ্যক মানুষ উদ্বাস্তু। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কয়েক হাজার ভাসমান মাইন (বোমা) ছেড়ে বন্দর দুটিকে সম্পূর্ণ অকেজো করে দিয়েছে। দেশের প্রধান দুটি রেল সেতু হার্ডিঞ্জ ও মেঘনা (ভৈরব) সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। আরও প্রায় চার হাজার ছোট বড় কালভার্ট ধ্বংসপ্রাপ্ত। বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে বড় সমস্যার মুখোমুখি হন প্রশাসন চালানোর মতো যোগ্য মানুষের অভাবে। এমনিতে পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলে বাঙালিরা যেন প্রশাসন ক্যাডারে উপরে উঠতে না পারে সে জন্য পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সব সময় সচেষ্ট থাকতো। যে ক’জন যোগ্য প্রশাসক ছিলেন তারা পাকিস্তানে আটকে পড়েছেন। কিছু ছিলেন বিদেশে। তাদের অনেকে আবার একটি অনিশ্চিত অবস্থায় বাংলাদেশে আসতে চাননি। অবশ্য পরবর্তীকালে সুখের সময় তাদের অনেকেই শুধু দেশে ফিরে আসেননি, ভালো ভালো পদও বাগিয়ে নিয়েছেন। দেশের ভেতর অনেক জুনিয়র কর্মকর্তাকে কয়েক ধাপ উপরে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীতেও তেমনটা হয়েছে। জিয়ার মতো অনেকেই মেজর থেকে ব্রিগেডিয়ার হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে বেশ কিছু শিক্ষাবিদকে পদায়ন করেন। দেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে তার ভাইস চেয়ারম্যান করেন প্রফেসর নুরুল ইসলামকে। সদস্য হন অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক আনিসুর রহমান ও অধ্যাপক মোশাররফ হোসেনের মতো বিশিষ্ট শিক্ষাবিদেরা। প্রথম শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলি আর প্রথম শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব পালন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক। তবে শিক্ষাবিদদের এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন অনেক আমলা তখন ভালো চোখে দেখেননি। পরিস্থিতির তেমন একটা উন্নতি এখনও হয়েছে তা বলা যাবে না। বঙ্গবন্ধু প্রয়োজনে বেশ কিছু সরকারি কর্মকর্তাকে তাদের অবসর জীবন থেকে ফিরিয়ে এনে কাজে লাগিয়েছিলেন। জাতির পিতার একটি বড় গুণ ছিল কাকে দিয়ে কী কাজ হবে তার বোঝার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তাঁর আমলে তদবির করে কেউ কোনও পদ বাগিয়েছেন তেমন একটা দেখা যায় না। এই সংস্কৃতির বর্তমানে অবসান হয়েছে অনেকটা।
বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনকাল ছিল অসম্ভব চ্যালেঞ্জের এবং সেই চ্যালেঞ্জ তিনি দক্ষ হাতে মোকাবিলা করেছিলেন। দেশের মানুষকে ধ্বংসস্তূপ থেকে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শিখিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ভাগ্য ভালো আমাদের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অনেক বন্ধুরাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল, যার মধ্যে ভারত ছাড়াও ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপান, যুক্তরাজ্য, পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহ, ইরাক। যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন না করলেও সেই দেশের মানুষ আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।
১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ বাংলাদেশসহ অনেক অনুন্নত দেশের অর্থনীতিতে প্রচণ্ড আঘাত হানে। চার ডলার ব্যারল তেলের দাম গিয়ে ঠেকে ১৫ ডলারে। বঙ্গবন্ধু এটি ঠিকই বুঝেছিলেন দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে সবার আগে কৃষককে বাঁচাতে হবে। তিনি কৃষকদের কয়েক হাজার সার্টিফিকেট মামলা বাতিল করে দিলেন। কৃষকদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য তিনি তাদের সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দিয়েছিলেন। কৃষকরা যাতে বিনা মূল্যে বীজ,সার, কীটনাশক পায় তা তিনি নিজে তদারক করতেন। বিভিন্ন স্থানে সেচ ব্যবস্থায় সহায়তা করার জন্য গভীর নলকূপের ব্যবস্থা করেছিলেন। কোন স্থানে তিনি সরকারি সফরে গেলে প্রথমেই তিনি খোঁজ নিতেন কৃষকদের অবস্থা কেমন আছে। কৃষকের গোলায় ধান না ওঠা পর্যন্ত বাংলাদেশকে খাদ্য সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল ভারত ও ইরাক। তারপর খাদ্য সাহায্য এসেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়া থেকে। এসব খাদ্যের বেশিরভাগই জনগণের মধ্যে রিলিফ হিসেবে বিনা মূল্যে বিতরণ করা হতো। জাপান সব সময় বাংলাদেশের ভালো সহায়তাদানকারী ভালো বন্ধু ছিল, এখনও আছে। অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আমদানি করার জন্য বঙ্গবন্ধুর হাতে সৃষ্টি হয়েছিল টিসিবি আর সুষ্ঠু বিতরণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কনজিউমার সাপ্লাইজ করপোরেশন বা কসকর। এসব সংস্থার কর্মকাণ্ড বঙ্গবন্ধু প্রয়োজনবোধে নিজেই তদারক করতেন। অনেকে হয়তো জানেন না, শুরুতে যেহেতু বাংলাদেশের কোনও বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য কানাডা ও সুইডেন কিছু ডলার বিনা শর্তে বাংলাদেশকে দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে এসেছিল তাদের দেশের নৌবাহিনী চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরকে মাইনমুক্ত করতে। এই কাজের জন্য তাদের সময় লেগেছিল দুই বছর। ব্রিটিশ আমলে ভারতের যে কোম্পানি হার্ডিঞ্জ ও মেঘনা রেল সেতু বানিয়েছিল তারা এসে আবার এই দুটি সেতুকে পুনর্নির্মাণ করেছিল। অনেক স্থানে মানুষ নিজের উদ্যোগে ভাঙা সেতু,কালভার্ট ও রাস্তা মেরামত করে নিয়েছিল।
১৯৭২ সালের ২৯ জুন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন, যার পরিমাণ ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে ছিল ২৮৫ কোটি টাকার পৌনঃপুনিক বাজেট আর ৫০১ টাকার উন্নয়ন বাজেট। বলাবাহুল্য, যেহেতু অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আয়ের কোনও সুযোগ ছিল না, সেহেতু পুরো বাজেটটাই অনেকটা বিদেশি সাহায্যনির্ভর ছিল। বর্তমান বছরে বাংলাদেশের বাজেট পাঁচশত আটষট্টি হাজার কোটি টাকা, যা দেশের গড় উৎপাদনের ১৮ শতাংশ, যার নব্বই ভাগ আসবে নিজস্ব উৎস থেকে। কোভিড মহামারির কারণে এই সংখ্যা কিছুটা হেরফেরও হতে পারে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিমাণ ছিল ২৮৮ মিলিয়ন ডলার, যার পরিমাণ বর্তমান সময়ে তিনশত ৮৪ বিলিয়ন ডলার। যে দেশটি পঞ্চাশ বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল আশি ডলার মাথাপিছু আয় দিয়ে, আজ বাংলাদেশের মানুষের আয় দুই হাজার ৬৪ ডলার। বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ-এর মতে, বাংলাদেশ বিশ্বে বারটি দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির একটি। ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল দশ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যা সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রয়োজনের দুই-তৃতীয়াংশ মেটাতে পারতো। আর সেই বাংলাদেশে বর্তমানে ছত্রিশ মিলিয়ন মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন করে ১৭ কোটি মানুষকে খাওয়ায়। প্রয়োজনে কোনও কোনও সময় অন্য দেশে তা রফতানিও করে বা রিলিফও দেয়। ১৯৭২ সালে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতো। মানে তারা দিনে আনে দিন খায়। আজ সেই সংখ্যা কুড়ি শতাংশ। হতদরিদ্র দশ শতাংশের নিচে। যখন বর্তমান প্রজন্মকে বলি আমরা হচ্ছি রিলিফ খাওয়া প্রজন্ম, তা তারা বুঝে না। যে দেশটির জন্ম হয়েছিল রিলিফ বা খয়রাত খেয়ে, সেই দেশের বর্তমান অবস্থায় আসা অনেকটা রূপকথার গল্পের মতো। যে দেশের ব্যাংকে কোনও বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না, সেই দেশের বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বঙ্গবন্ধু যখন সরকার গঠন করে তখন দেশের গড় প্রবৃদ্ধি মাইনাস ১৪.০০ অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রেই পতনের জোরালো আওয়াজ। এটি দেখে বিশ্বের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন বাংলাদেশের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। এমন একটি পতিত রাষ্ট্র যদি আবার জেগে ওঠে তাহলে বিশ্বে আর কোনও পতিত রাষ্ট্র থাকবে না। এই ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করতে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হয়ে দাঁড়ায় ৩.৩ শতাংশ। আর ১৯৭৪ সালে তা উঠে যায় ৯.৬ শতাংশে। এর প্রধান কৃতিত্ব কৃষকদের। যাত্রার শুরুতে বঙ্গবন্ধু কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়ার যে ব্যবস্থা করছিলেন তার ফল পেতে শুরু করে জাতি। সবকিছু যখন ঠিক চলছিল সবার অলক্ষে বঙ্গবন্ধুর বেশ ক’জন নিকট আস্থাভাজন তাঁকে হত্যা করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ১৯৭৪ সালে পর পর তিনটি বন্যা ও খরাজনিত কারণে দেশে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বিশ্বের অনেক দেশেও একই কারণে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। অবস্থা এমন, টাকা দিলেও বিশ্ববাজারে চাল বা গম মিলে না। ব্যতিক্রম শুধু যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চাল বিক্রি করতে নানা অজুহাতে অস্বীকার করে এবং পিএল-৪৮০ পরিকল্পনার অধীনে যে খাদ্য সাহায্য পেতো তাও বন্ধ করে দেয়। অজুহাত, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ‘শত্রু’ রাষ্ট্র কিউবার কাছে কিছু পাটের বস্তা বিক্রি করেছিল। দেশে দেখা দেয় খাদ্যাভাব। বঙ্গবন্ধু পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য দুর্গত এলাকায় অনেক লঙ্গরখানা খোলেন। তারপরও প্রায় দুই হাজার মানুষ বিভিন্ন জায়গায় খাদ্য অভাবে মৃত্যুবরণ করে। বেশিরভাগ সমস্যাটি খাদ্যের প্রাপ্যতা ছিল না তা নয়, ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা। সময় মতো খাদ্য পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ঠিক এই সময়টাকে ষড়যন্ত্রকারীরা বেছে নেয় বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করার জন্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে তাকে ঘাতকরা সপরিবারে হত্যা করে। দেশের বাইরে থাকার কারণে বঙ্গবন্ধুর দু‘কন্যা বেঁচে যান, যার একজন শেখ হাসিনা,বর্তমানে দেশের প্রধানমন্ত্রী, যার হাত ধরে বর্তমানে বাংলাদেশ এক অন্য উচ্চতায়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর তাঁর বিশ্বস্ত খন্দকার মোশতাকের হাত ধরে ক্ষমতা দখল করেন দেশের প্রথম সেনা শাসক জেনারেল জিয়া, যাকে বঙ্গবন্ধু নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। ক্ষমতা দখল করেই জিয়া বঙ্গবন্ধু আর আওয়ামী লীগের নাম নেওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এরপর তিনি প্রায় ছয় বছর বেঁচে ছিলেন। এই সময়ে তিনি বাংলাদেশকে আবার একটা মিনি পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করেন। ১৯৮১ সালের মে মাসের ৩০ তারিখ চট্টগ্রামে জিয়া একদল সেনা সদস্যদের হাতে নিহত হলে তার উপ-রাষ্ট্রপতি সাত্তারের হাত ঘুরে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এরশাদ। গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হলে নির্বাচনের মাধ্যমে জিয়ার বিধবা স্ত্রী বেগম জিয়া ক্ষমতায় আসেন ১৯৯১ সালে। সবাই আশা করেছিলেন পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। তা না হয়ে বরং হয় উল্টা। বিভিন্ন সময় চেষ্টা করা হয় শেখ হাসিনাকে হত্যার। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ একুশ বছর পর শেখ হাসিনা তাঁর দলকে ক্ষমতায় আনেন এবং তিনি সরকার গঠন করেন। মাঝখানে ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বিরতি দিয়ে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু কন্যা বাংলাদেশের টানা তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী। এই সময়ে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বে একটি উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরেছেন। যদিও বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদযাপন করছে, এই পঞ্চাশ বছর থেকে একুশ বছর বিয়োগ করতে হবে। যে বাংলাদেশ একসময় পরিচিতি সমস্যায় ভুগতো সেই বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বে পরিচিত স্রেফ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যার কারণে। যে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল শূন্য হাতে সেই বাংলাদেশ এখন মহাশূন্যে উপগ্রহ পাঠায়, নিজের অর্থে পদ্মা সেতু বানায়। আর যখন বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালন শেষ করলো আর যখন দেশটি তারা জন্মের পঞ্চাশ বছর পূর্তি করছে তখন জাতিসংঘ খবর দিলো বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নত হওয়ার প্রাথমিক শর্তগুলো পূরণ করেছে। পিতা যে দেশটার ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন, অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে সেই বাংলাদেশ এখন বিশ্বের চোখে এক বিস্ময়। এই কৃতিত্বের দাবিদার বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। কারণ, তাঁর নেতৃত্ব না হলে এই কঠিন পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব হতো না। শেখ হাসিনা এখন শুধু একজন প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি একজন বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রনায়ক। পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ অনেক কঠিন পথ অতিক্রম করেছে। সামনের পঞ্চাশ বছর আরও কঠিন হতে পরে। আজ আমরা যারা পেছনের পঞ্চাশ বছরের জয়গান গাইছি, সামনের পঞ্চাশ বছর পর আমরা কেউই থাকবো না। সেই অনাগত পঞ্চাশ বছর আরও সফল হোক, এই প্রত্যাশায় বাংলাদেশকে অভিবাদন। জয়তু বঙ্গবন্ধু জয়তু শেখ হাসিনা,জয়তু বাংলাদেশ। জয় বাংলা।
লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।