জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামালের জন্মদিন আজ। ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট তার জন্ম। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা বইয়ে অন্য সন্তানদের মতো শেখ কামালকে নিয়ে তার স্মৃতি কম-বেশি তুলে ধরেছেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ১৩টি পৃষ্ঠায় রয়েছে শেখ কামালকে নিয়ে স্মৃতিচারণ। কারাগারের রোজনামচা বইয়েরও ৬৫টি পৃষ্ঠায় শেখ কামালকে নিয়ে লিখেছেন। বইয়ে শেখ কামালের জন্মের সময়কার ঘটনা বর্ণনা না থাকলেও একেবারে ছোট সময় থেকেই তাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু তার স্মৃতিময় ঘটনা তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন ছেলেমেয়ে কাছে না থাকার কষ্ট-বেদনার কথাও।
প্রথমে শেখ কামালের প্রসঙ্গ আসে অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ের ১৪৬ পৃষ্ঠায়। এটি কামালের জন্মের কিছুদিন পরের ঘটনা। ওই সময় এক মাসের বেশি পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করে দেশে ফিরছিলেন বঙ্গবন্ধু। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি থাকা অবস্থায় পাকিস্তান থেকে দিল্লি-কলকাতা হয়ে বাংলাদেশে আসার সময়কার ঘটনা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘গোয়েন্দা বিভাগ প্রস্তুত আছে আমাকে গ্রেফতার করবার জন্য। আমিও প্রস্তুত আছি, তবে ধরা পড়ার পূর্বে একবার বাবা-মা, ভাইবোন, ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা করতে চাই।’ ‘...মন চলে গেছে বাড়িতে। কয়েকমাস পূর্বে বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে। ভালো করে দেখতেও পারিনি ওকে। অনুভব করতে লাগলাম যে, আমি ছেলেমেয়ের বাবা হয়েছি।’
পাকিস্তান থেকে ফিরে ওই সময়ে গ্রামের বাড়িতে ৭/৮দিন থেকে মাদারীপুরে বোনের বাড়িতে আরও সাতদিন বেড়িয়ে ঢাকায় ফিরছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর সঙ্গে স্ত্রী-সন্তানও এসেছিলেন মাদারীপুর পর্যন্ত। সচারচর বঙ্গবন্ধু লঞ্চে বারিশাল হয়ে ঢাকায় গেলেও গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় বঙ্গবন্ধু কৌশলগত কারণেই সেবার মাদারীপুর হয়ে আসছিলেন। দিনের বেলায় এলে মেয়ে কান্নাকাটি করবে বলেই তিনি সেখান থেকে রাতের বেলা ঢাকার উদ্দেশে রওয়ান দেন বলে অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ে লিখেছেন। এখানে বড় ছেলে শেখ কামালের কথাও উঠে আসে। এ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, ‘রাতের বেলায় রওয়ানা হয়ে এলাম। দিনের বেলায় এলে হাচু কাঁদবে। কামাল তো কিছু বোঝে না।’
একবার গ্রেফতার অবস্থায় ফরিদপুর কারাগার থেকে জাতির পিতাকে গোপালগঞ্জে আনা হয়েছিল মামলার তারিখে। তখন গোপালগঞ্জ থানা ঘাটে গিয়ে বঙ্গবন্ধু দেখেন তাদের নৌকা। পিতা, স্ত্রী ও সন্তানরা এসেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘এক বছর পরে আজ ওদের সাথে আমার দেখা। হাচিনা আমার গলা ধরল আর ছাড়তে চায় না। কামাল আমার দিকে চেয়ে আছে। আমাকে চেনেও না আর বুঝতেও পারে না। আমি কে?’
বইয়ের ১৮৫ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায় উঠে এসেছে খুলনা কারাগার থেকে গোপালগঞ্জে মামলার তারিখে হাজির হওয়ার দিনে স্ত্রী-সন্তানদের সাথে দেখা হওয়ার প্রসঙ্গে। ওই সময় কামাল প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, ‘‘কামালও আমার কাছে এখন আসে। হাচু ‘আব্বা’ বলে দেখে কামালও ‘আব্বা’ বলতে শুরু করেছে।’’
ফরিদপুর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে পাঁচ দিনের মাথায় টুঙ্গিপাড়া পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু। কারাগারে অনশন করার কারণে শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল ছিলেন তিনি। বাড়ি আসার পর হাচু গলা জড়িয়ে ধরলেও কামাল তার কাছে আসে নাই। কামাল প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘কামাল আমার কাছে আসলো না। তবে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।’
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এ দফায় বাড়ি ফেরার পর শেখ কামালকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ঘটনাটি খুবই আবেগজড়িত। কতদিন পর জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন তা আত্মজীবনীতে উল্লেখ নেই। তবে তার লেখা ‘সাতাশ-আটাশ মাস পরে আমার সেই পুরানা জায়গায়, পুরানা কামরায়...।’ এতে ধরে নেওয়া যায় ওই ২৭/২৮ মাসই তিনি জেলে ছিলেন। অবশ্য আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন তোফায়েল আহমেদের সংসদে দেওয়া এক বক্তব্যে জানা যায়, ওই সময় ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টানা ৭৮৭ দিন তিনি কারাভোগ করেন। এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর ষষ্ঠবারের মতো কারাভোগ এবং ওই সময় পর্যন্ত বেশিদিন কারাগারে থাকার ঘটনা। জন্ম তারিখ হিসাবে ওই সময় শেখ কামালের বয়স হয়েছিল ২ বছর ৬ মাস ২০ দিন।
জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তখন বঙ্গবন্ধু দেড় মাসের মতো টুঙ্গিপাড়ার গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। এ সময় শেখ কামালকে নিয়ে আবেগঘন একটি দিনের ঘটনা আত্মজীবনীর ২০৯ পৃষ্ঠায় এভাবে উল্লেখ করেছেন বঙ্গবন্ধু— ‘‘একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’ আমি আর রেণু দু’জনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘আমি তো তোমারও আব্বা।’ কামাল আমার কাছে আসতে চাইতো না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়!’’
দেড়মাস বাড়িতে কাটিয়ে বঙ্গবন্ধু এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বরিশাল হয়ে ঢাকা আসেন। ঢাকায় রওয়ানা দেওয়ার সময় শেখ হাসিনা ও শেখ কামাল কান্নাকাটি করেন বলে তিনি আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘হাচিনা ও কামাল আমাকে ছাড়তে চায় না। ওদের ওপর আমার খুব দুর্বলতা বেড়ে গেছে। রওয়ানা করার সময় দুই ভাইবোন খুব কাঁদল।’
অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শেষ দিকে পিতার অসুস্থতাজনিত কারণে মুক্তি পাওয়ার পর লঞ্চে শেখ কামালসহ পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎ হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ রয়েছে। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী-সন্তান ঢাকায় থাকতেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। তখন বঙ্গবন্ধুর পিতা খুবই অসুস্থ এমন তথ্যের টেলিগ্রাম আছে স্ত্রী রেণুর কাছে। এটি পেয়ে সন্তানদের নিয়ে তিনি গ্রামের বাড়িতে রওয়ানার আগে টেলিগ্রামের কপি সাথে দিয়ে সরকারের কাছে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চেয়ে একটি আবেদনও করেন তিনি। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে রাত ৯টায় বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া হয়। এদিকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চয়তা না পেয়ে এবং শ্বশুর বেশি অসুস্থ হওয়ায় বাদামতলী ঘাট থেকে জাহাজে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী সন্তান রওয়ানা দেন। মুক্তি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তাদের যাত্রা করার বিষয়টি জানতে পারেন। এও জানতে পারেন যে, ওই জাহাজ ১১টায় নারায়ণগঞ্জ পৌঁছবে। পরে তিনি নারায়ণগঞ্জ গিয়ে জাহাজ ধরেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘জাহাজ ছাড়ার ১৫ মিনিট পূর্বে আমি নারায়ণগঞ্জ ঘাটে পৌঁছালাম। আমাকে দেখে রেণু আশ্চর্য হয়ে গেলো। বাচ্চারা ঘুমিয়ে ছিল। রেণু তাদের ঘুম থেকে তুলল। হাচিনা ও কামাল আমার গলা ধরল, অনেক সময় পর্যন্ত ছাড়ল না, ঘুমালও না। মনে হচ্ছিল ওদের চোখে আজ আর ঘুম নাই।’
কারাগারের রোজনামচা বইয়ের ১৫৯ পৃষ্ঠায় শেখ কামালের প্রসঙ্গ এসেছে। ১৯৬৬ সালের ১২ জুলাই স্ত্রী-সন্তান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারাগারে দেখা করতে গেলে ওইদিন কামালের পড়াশুনা নিয়ে কথা হয়। কারাগারের রোজনামচা বইয়ে বিষয়টি বঙ্গবন্ধু এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘রেণু বলল, কামাল খুব লেখাপড়া আরম্ভ করেছে। আগামীবারে মেট্রিক পরীক্ষা দেবে। সকলকে মন দিয়ে পড়তে বলে বিদায় নিলাম।’
পরের বছর কামালের মেট্রিক পরীক্ষার সময়কালে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘৬ এপ্রিল (১৯৬৭) থেকে আমার বড় ছেলে মেট্রিক পরীক্ষা দেবে। কোনো খবর পাই নাই কেমন পরীক্ষা দিলো।’ পরে আবার লেখেন ‘কামাল এসেছিল। বলল পরীক্ষা ভালো দিয়েছে। এই খবরটার জন্য ব্যস্ত ছিলাম।’
Publisher - Lutfur Rahman (Uzzal)
Published By The Editor From chttimes (Pvt.) Limited (Reg.No:-chttimes-83/2016)
Main Road,Gurosthan Mosque Market, Infront of district food Storage, Bandarban hill district,Bandarban.
Phone - News - 01673718271 Ad - 01876045846
Copyright © 2024 Chttimes.com. All rights reserved.