দৈনিক ১৩ হাজারের বেশি করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। শীতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় সংক্রমণ রোধে এই কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এছাড়া ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সর্বস্তরে মাস্ক ব্যবহার, হাত ধোয়া ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
সম্প্রতি ৮ জন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা দ্বিতীয় সংক্রমণ প্রতিরোধে সমন্বিতভাবে এসব কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেন। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আজ রাতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এসব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সভা হওয়ার কথা আছে। কবে থেকে বর্ধিত হারে নমুনা পরীক্ষা শুরু হবে সে বিষয়ে আজকের সভায় সিদ্ধান্ত হতে পারে। এর আগে জাতীয় কমিটিও বৈঠক করেছে।
করোনায় দ্বিতীয় সংক্রমণ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, বিশ্বব্যাপী মানুষ করোনাকে অবহেলা করছে। এর ফলে আমেরিকা, ইউরোপসহ অনেক দেশেই করোনায় সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হয়েছে।
আমাদের দেশেও শীতকালে করোনায় সেকেন্ড ওয়েভ শুরুর আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হলে কি কি করণীয় সে ব্যাপারে প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
করোনা মোকাবেলায় ইতোমধ্যেই দেশের স্বাস্থ্য খাত সক্ষমতা দেখিয়েছে। আক্রান্ত বিবেচনায় মৃত্যুহার বিশ্বের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হলেও দেশের স্বাস্থ্য খাত এভাবেই মোকাবেলা করতে প্রস্তুত রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরীক্ষা কমে যাওয়ায় দেশে কয়েক সপ্তাহ ধরে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা দুই হাজারের নিচে নেমে এসেছে। তবে এর মধ্যেই শনাক্তের সংখ্যাও ধীরে ধীরে বাড়ছে।
দৈনন্দিন মৃত্যুর সংখ্যা কখনও কমছে আবার বাড়ছেও। এ পরিস্থিতিতে গত রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শীতকালে সংক্রমণের হার বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
ওই রাতেই বৈঠক করে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি এ সংক্রান্ত রাডম্যাপ তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা জানায়।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, প্রণীত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
তাছাড়া শনিবার রাত ৮টায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এ সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে একটি মন্ত্রণালয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলোকে কার্যক্রম বণ্টন করে দেয়া হয়।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদফতর ৮ জন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শে দেশে করোনার দ্বিতীয় সংক্রমণ মোকাবেলায় বেশকিছু কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে নতুন সংক্রমশ শনাক্তে দৈনিক ১৩ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষার কর্মপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি মিলে ১০৩ অনুমোদিত ল্যাব কাজে লাগানো হবে। এছাড়া সম্প্রতি র্যাপিড এন্টিজেন পরীক্ষা অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে সাড়ে ১০ লাখ এন্টিজেন পরীক্ষার কিট আনার প্রক্রিয়া চলছে।
রাশিয়া, চায়না এবং ইন্ডিয়া থেকে ভ্যাকসিন আনতে যোগাযোগ করা হচ্ছে। গ্লোবাল ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স বা গ্যাভিও বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দেশের তালিকায় রেখেছে।
মোট চাহিদার ২০ শতাংশ ভ্যাকসিন গ্যাভির মাধ্যমে আসবে বলেও প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে অধিদফতর।
এসব বিষয়ে অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) সিবিএইসসি, সিডিসি, আইইডিসিআর ও প্ল্যানিং বিভাগ সমন্বিতভাবে কাজ করছে।
দ্বিতীয় সংক্রমণ মোকাবেলায় কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে জেলা-উপজেলা পর্যায় থেকে শুরু করে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন পর্যায়ে নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে এটি বাস্তবায়ন করা হবে।
পাশাপাশি এসব তথ্য লিপিবদ্ধ করা হবে। নির্ধারিত পর্যায়ে থাকবে ফলোআপের ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান আসবে বিশ্বব্যাংকের ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্ল্যানিং অ্যান্ড প্রিপিয়ার্ডন্সে প্রকল্প থেকে।
রোগ যেন ব্যাপক হারে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য কঠোরভাবে কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা হবে। জনসাধারণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মাস্ক ব্যবহার, হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে পর্যাপ্ত জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বারোপ করা হবে।
এছাড়া প্রতিটি জেলা হাসপাতালে কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড ইউনিট নিশ্চিত করা, পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা, ৭৬টি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি কোভিড সংক্রান্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে এই কর্মপন্থায়।
এর আগে ২৮ আগস্ট স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলমের সভাপতিত্বে কোভিড-১৯ জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় আসছে শীতে দেশে করোনার দ্বিতীয় সংক্রমণ আসবে কিনা, এলে করণীয় কি সে বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বলা হয়, দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ওয়েভ বা ঢেউয়ের জন্য এখনই প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারলে সংক্রমণ কমানো সম্ভব হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাসের ওপর পরিবেশের বা তাপমাত্রার সরাসরি তেমন কোনো প্রভাব নেই। তবে আসছে শীতকালে দেশে কোভিড-১৯ এর প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শুষ্ক আবহাওয়ায় ভাইরাসটির বাতাসে ভেসে বেড়ানো ক্ষমতা বাড়বে। পাশাপাশি শীতকালে এ দেশের মানুষের একত্রে জড়সড় হয়ে বসার প্রবণতা এই সংক্রমণ আরও ত্বরান্বিত করতে পারে।
এটি হতে পারে দেশে করোনার দ্বিতীয় সংক্রমণ। এদিকে করোনাভাইরাস বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক দ্রুতগতিতে রূপ পরিবর্তন করছে জানিয়ে গবেষকরা বলেন, এসব পরিবর্তন দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ার কারণ হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, তাপমাত্রার সঙ্গে করোনাভাইরাসের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকলেও শীতে এর প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কারণ শুষ্ক আবহাওয়ায় এ ভাইরাস বাতাসে বেশিক্ষণ ভেসে থাকে, তাই সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। দ্বিতীয়ত, শীত এবং বর্ষায় মানুষ ঘর থেকে কম বের হয়, গাদাগাদি করে থাকে, সামাজিক দূরত্ব কম পালন করা হয়, ফলে সংক্রমণ বেড়ে যায়।
তৃতীয়ত, ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় অ্যাজমা, সিওপিডিসহ ফুসফুসের রোগের তীব্রতা বেড়ে যায়। করোনাভাইরাসের মূল টার্গেটই যেহেতু ফুসফুস, সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই শরীরে অল্প পরিমাণ ভাইরাস প্রবেশ করেই বেশি ক্ষতি করতে পারে।
সোজা কথা, সতর্ক না হলে কয়েক মাস পর আবার লাফ দিয়ে শনাক্ত এবং মৃত্যু বেড়ে যেতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, সারা বিশ্বে সব মিলিয়ে ৬ ধরনের করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ২৬৩টি করোনাভাইরাস পর্যবেক্ষণ করে বিসিএসআইআরের গবেষকরা ৪ ধরনের ২৪৩টি জিআর ক্লেড, ১৬টি জিএইচ ক্লেড, ৩টি জি ক্লেড এবং ১টি ওক্লেড করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পেয়েছেন।
এছাড়া করোনার নমুনাগুলোর শতভাগ ক্ষেত্রে ৪টি মিউটেশনে পুনরাবৃত্তি লক্ষ্য করা গেছে। এসব পরিবর্তন দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য মূলত দায়ী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এসএম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, তাপমাত্রার ওপর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নির্ভরশীল নয়। শীতে সংক্রমণ বাড়বে কিনা সেটি নিশ্চিত করে বলা কঠিন।