আহমেদ তোফায়েল
পদ্মা সেতু চালু হলে প্রতিদিন গড়ে ২৪ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। ঢাকার সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার। যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিসর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে জাতীয় ও আঞ্চলিক প্রবৃদ্ধি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মা সেতুকে ঘিরে ওই অঞ্চলের কৃষি ও প্রক্রিয়া জাত শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাড়বে মজুরি ও জমির দামও। তবে এসব কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নির্ভর করবে আগাম ব্যবস্থাপনার ওপর।
তবে পদ্মা সেতুকে দেশের অর্থনৈতিক করিডোর করতে আগাম বিনিয়োগ আকর্ষণের তাগিদ দিয়েছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, শুরু থেকে পদ্মা সেতুর সুফল পেতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে দ্রম্নত অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা ও সচল করতে হবে। সেখানে শিল্পায়নে প্রয়োজনীয় গ্যাস, বিদু্যৎসহ অবকাঠামো এখন থেকেই গড়ে তুলতে হবে। তারা বলছেন, পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ করা অর্থের সুফল পেতে যৌক্তিক টোল নির্ধারণসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এখনই মহাপরিকল্পনা নেওয়া উচিত।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, এটাকে কেবলমাত্র ট্রান্সপোর্ট করিডোর হিসেবে চিন্তা না করে অর্থনৈতিক করিডোর হিসেবে চিন্তা করতে হবে। এ সেতুকে ঘিরে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ আকর্ষণ করা, বিপণন ব্যবস্থাকে আরও সম্প্রসারণ করা, সেই সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের দক্ষতা বৃদ্ধি করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির প্রতি এখনই মনোযোগ দিতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম যায়যায়দিনকে বলেন, দক্ষিণ অঞ্চলের শিল্পায়নকে উৎসাহিত করতে হলে অবশ্যই সেখানে যোগাযোগের মাধ্যম ছাড়াও প্রয়োজন হবে গ্যাস ও বিদু্যৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা। দক্ষ লোকজন যেন সেখানে থেকে তাদের সন্তানদের ভালো স্কুল-কলেজের পড়াতে পারেন, সে রকম সামাজিক অবকাঠামোতে বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে।
পদ্মা সেতুর মাধ্যমে পায়রা ও মোংলাবন্দর ব্যবহারের পরিসরও বেড়ে যাবে। ফলে কেবল অভ্যন্তরীণই নয়, উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে কাজে লাগানোর কথা বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এটির মাধ্যমে কেবল বাংলাদেশ নয়, ভুটান ভারত এবং নেপালের সাথে সমান্তরাল যে বিভিন্ন উদ্যোগগুলো চলছে, আমরা কাজে লাগাতে পারব পদ্মা সেতুকে ব্যবহার করে।’
এদিকে, মোংলা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর হলেও এর ব্যবহার তেমন হচ্ছে না। পদ্মা সেতু হলে এই বন্দর এবং নতুন স্থাপিত পায়রা সমুদ্রবন্দর গতিশীল হবে। তবে এজন্য বন্দর দুটির নাব্য ও ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে হবে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে বন্দর দুটির সম্ভাবনা বাড়ছে। দেশীয় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি নেপাল, ভুটান ও ভারতের ব্যবসায়ীরা তা ব্যবহারের সুযোগ নেবেন। তবে এজন্য বন্দরে বড় জাহাজ আসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) মোংলা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও পায়রায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। সংস্থাটির নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী জানান, দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দক্ষিণ অঞ্চলকেন্দ্রিক সাতটি স্পেশাল ইকোনমিক জোন রয়েছে। তার জন্য প্রায় ২ হাজার ৭০০ একর জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অন্তত একটি বা দুটি অর্থনেতিক অঞ্চলের কার্যক্রম দ্রম্নতগতিতে চালু করে দিতে হবে। এসব জোনগুলো তৈরি হলে দেশে এবং বিদেশের বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ দেখাবেন বিনিয়োগে।
বিআইডিএসের সাবেক জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো আব্দুল হাই মন্ডল যায়যায়দিনকে বলেন, সেতু হলে অর্থনীতি চাঙা হবে, সম্প্রসারিত হবে বাজার। এতদিন সেখানে কৃষিপণ্যের বাজার ছোট ছিল, এখন সেই বাজার বড় হবে। কৃষকেরা ঢাকায় ফসল পাঠাতে পারবেন। ধারণা করা যায়, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আয় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। যোগাযোগ উন্নত হলে স্বাভাবিকভাবে দক্ষিণাঞ্চলে নতুন শিল্পায়ন হবে। অনেক মানুষ কাজ পাবে। বেকারত্ব কমবে, কমবে মানুষের ঢাকায় আসার প্রবণতা।
গত বৃহস্পতিবার স্বপ্নের পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যান বসানো শেষ হয়েছে। বাকি অবকাঠামো নির্মাণের পর আগামী বছরের শেষের দিকে এ সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সড়ক সেতুর পাশাপাশি কাজ চলছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের। রেল যোগাযোগ শুরু হলে বিনিয়োগ আরও চাঙ্গা হবে। বড় শিল্পোদ্যোক্তাদের অনেকেই পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগ পরিকল্পনা করছেন। পদ্মার ওপারের বিভিন্ন জেলায় জমি কিনেছেন কোনো কোনো শিল্পগোষ্ঠী। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান জমি খুঁজছে। সরকারও সেতুকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলছে অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চল। এক কথায় বিনিয়োগবঞ্চিত পদ্মার ওপার এখন বিনিয়োগের আকর্ষণীয় কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে।
দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা বারবার জরিপ করে বলেছে, পদ্মায় সেতু আঞ্চলিক ও জাতীয়ভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে। বিশ্বব্যাংক তাদের আগের এক গবেষণায় বলেছে, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে। যদিও এখন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পদ্মা সেতুতে রেল চলাচলের ব্যবস্থা করায় জাতীয় অর্থনীতিতে এর প্রভাব আরও বেশি হবে।
গবেষণা সংস্থা পিআরআইর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এই সেতুর ফলে আগামী ৩১ বছরে সড়ক ব্যবহারকারীরা পরিবহণ খাত থেকে এক লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকার সুবিধা পাবে। এছাড়া বিনিয়োগ আকর্ষণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূর করার মতো অর্থনৈতিক সুবিধা তো থাকছেই।
জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) পর্যালোচনায়ও একই ধরনের সম্ভাবনা উঠে এসেছে। পিআরআইর সিনিয়র ইকোনমিস্ট ড. আশিকুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, পদ্মা সেতুর প্রথম সুবিধা হচ্ছে, যাতায়াত সময় কমবে। পাশাপাশি দেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে অন্যান্য এলাকার বৈষম্য কমবে। ঢাকার ওপরও অনেক চাপ কমবে। এছাড়া বরিশাল ও খুলনা বিভাগে বিনিয়োগ বাড়বে। ইতোমধ্যে বিনিয়োগ শুরু হয়েছে। প্রয়োজনীয় সুবিধা ও পরিবেশ নিশ্চিত হলে বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র হবে এ অঞ্চল। এতে এসব অঞ্চলে কর্মসংস্থান বাড়বে।