তিস্তা পাড়ে আনন্দের বন্যা


অনলাইন ডেস্ক প্রকাশের সময় :১৪ মার্চ, ২০২১ ৮:২৮ : অপরাহ্ণ 251 Views

তিস্তা মহাপ্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে’ এ খবরে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা পাড়ের মানুষের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইছে। সরকার একমাস আগে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে চীন সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে সহজ শর্তে অর্থের জোগান দিতে বলেছে। এ খবর প্রচার হওয়ার পর তিস্তা পাড়ের মানুষ দারুণ খুশি। নিলফামারীর ডালিয়া পয়েন্ট থেকে শুরু করে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের নদীপাড়ের মানুষের মধ্যে যেন লেগে গেছে ঈদের খুশি। চীনের তিস্তা মহাপ্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভাগ্যের চাকা বদলে যাবে। অর্থনৈতিকভাবে চরের মানুষ স্বাবলম্বী হবেন। এ জন্য তারা বেহায় খুশি। রংপুরের কাউনিয়া তিস্তা ব্রিজে দাঁড়িয়ে টেপামধুপুর গ্রামের মো: মকবুল হোসেন নিজের খুশি প্রকাশ করে বলেন, ‘হামার দীর্ঘদিনের শপন (স্বপ্ন) পূরণ হইল বাহে। তিন্তা নদী খনন করি যদি চীন সরকার প্রকল্প করেন, তাহলে হামরা কাজ-কাম করি খাবার পাবো। প্রতিবছর বন্যার সময় নদীভাঙন আর ফালগুন চৈত মাসে নদী শুকিয়ে গেলে দারুণ কষ্টে পড়তে হয়।’

জানা গেছে, তিস্তা প্রকল্পে সহজশর্তে অর্থের জোগান সংক্রান্ত চিঠি দেয়ার পর দুই দেশের ক‚টনৈতিক পর্যায়ে সফলভাবে আলোচনা চলছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার যেমন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী; তেমনি চীন সরকারও অর্থ দিতে প্রস্তুত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিস্তা প্রজেক্টের কাজ শুরু হচ্ছে এই খবর নদীপাড়ের মানুষ ‘ঈদের চাঁদ’ দেখার মতো করেই প্রচার করছে। হাট-বাজার, ট্রেন-বাস এবং যেখানে যাকে পাচ্ছেন তিস্তা প্রজেক্ট হচ্ছে এ খবর দিচ্ছেন। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে জানতে চাচ্ছেন ভারতের দাদাগিরিকে থোরাই কেয়ার করায় উল্টরাঞ্চলের মানুষের শেখ হাসিনা ইতিহাস হয়ে থাকবেন। নিলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে বসবাস করেন মশিউর রহমান। তিনি জানালেন, তিস্তা প্রকল্পে চীনের কাছে অর্থ দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের চিঠি দেয়ার খবরে মানুষ খুবই খুশি। তাদের ধারণা ছিল ভারতের মোদির বাধার মুখে বর্তমান সরকার চীনের অর্থায়নে তিস্তা প্রজেক্টের কাজ করতে পারবে না। কিন্তু সরকারের ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রæতা নয়’ নীতিকে কঠোর হওয়ায় এ প্রকল্প শুরু হতে যাচ্ছে। এটা উত্তরাঞ্চলের দুই কোটি মানুষের ভাগ্যের চাকা পাল্টে দেবে। সে জন্যই সবাই খুশি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দারিদ্র্যপীড়িত উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে স্থায়ী সমৃদ্ধশালী করতে তিস্তা নদীকে ঘিরে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে- ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। প্রকল্প পরিকল্পনা ও নদী পর্যবেক্ষণ কাজ দুই বছর ধরে করেছে চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না পাওয়ার ও চায়না রিভার ইয়েলো। তিস্তা প্রকল্পটি হবে আধুনিক, দৃষ্টিনন্দন ও যুগোপযোগী। উত্তরাঞ্চলের ‘পাগলা নদী’ খ্যাত তিস্তা ড্রেজিং করে কোটি কোটি মানুষের দুঃখ ঘুচানো হবে। এ প্রকল্পে ১০৮ কিলোমিটার নদী খনন, নদীর দু’পাড়ে ১৭৩ কিলোমিটার তীর রক্ষা, চর খনন, নদীর দুই ধারে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ, বালু সরিয়ে কৃষিজমি উদ্ধার ও ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা করা হবে। শুধু তাই নয়, এ প্রকল্পের সুবিধা নিয়ে প্রতি বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হবে। চীনের প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলার মানুষের ভাগ্যের চাকা।

রংপুরের স্থানীয় সাংবাদিক আবদুল হক জানালেন, তিস্তা প্রকল্প হচ্ছে এ খবর বাংলাদেশের মিডিয়ায় কম করে প্রচার করায় ভারতের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন গ্রামের মানুষ। তাদের অভিযোগ ভারত অখুশি হবে, সেই ভয়ে দেশের অনেক মিডিয়া চীনের কাছে তিস্তা প্রকল্পের অনুমতি দিয়ে চিঠি দেয়ার খবর প্রচার করছে না। রংপুরের নব্দিগঞ্জের কয়েকজনের মন্তব্য এমন, ভারত যুগের পর যুগ ধরে তিস্তা চুক্তির মুলা ঝুলিয়ে রেখেছে। চীনের তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারত থেকে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত পানি আর প্রয়োজন পড়বে না। তিস্তা নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বৃদ্ধি পাবে। বন্যায় উসলে ভাসাবে না গ্রাম-গঞ্জ জনপদ। আবার শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে যাবে না। সারা বছর নৌচলাচলের মতো পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। নৌবন্দর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দুই পাড়ে থানা, কোস্টগাড, সেনাবাহিনীর জন্য ক্যাস্প স্থাপন করা হবে।

রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের পানিয়ালের ঘাটে বসবাস করেন ছলিম উদ্দিন। তিস্তা প্রকল্প হচ্ছে তার অনুভূতি কি জানতে চাইলে বলেন, ‘ভারত গজলডোবায় পানি আটকে দেয়ায় হামরা পানির জন্য হাহাকার করি। মাছ ধরে চৌদ্দপুরুষ জীবন চালিয়েছে। এখন রংপুরে এসে রিকশা চালাই। তিস্তা যদি খুরে পানি রাখা যায়, তাহলে হামার সবাই উপকার হয়। শহরত রিকশা চালানো বাদ দিয়ে গ্রামে যায়া কাম করিম’।

জানা গেছে, তিস্তা প্রকল্পে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুইপারে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর, নদী খনন ও শাসন, ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা, আধুনিক কৃষি সেচ ব্যবস্থা, মাছ চাষ প্রকল্প পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এতে ৭ থেকে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। তিস্তা নদীরপাড়ের জেলাগুলো নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্ধায় চায়নার তিনটি প্রতিনিধি দল কাজ করছেন। তারা এসব কাজের পরামর্শ দিয়েছেন। মূলত এ প্রকল্পের আওতায় তিস্তা নদীর দুইপাড়ে ২২০ কিলোমিটার গাইডবাঁধ নির্মাণ করা হবে। বাঁধের দুইপাশে থাকবে সমুদ্র সৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ। যাতে পর্যটকরা লংড্রাইভে যেতে পারেন। এছাড়া এ রাস্তা দিয়ে পণ্য পরিবহন করা হবে। নদী পাড়ের দুইধারে গড়ে তোলা হবে- হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন নগরী। টাউন নামের আধুনিক পরিকল্পিত শহর, নগর ও বন্দর গড়ে তোলা হবে। তিস্তাপাড় হয়ে উঠবে- পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো সুন্দর নগরী।

উত্তরাঞ্চলে ডালিয়ায় তিস্তা সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হলে ভারত এই প্রকল্পের ৬৫ কিলোমিটার উজানে কালীগঞ্জের গজলডোবায় সেচ প্রকল্প তৈরি করে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত তিস্তা নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে তিস্তা পাড়ে প্রতিবছর বন্যা ও খরা দেখা দেয়। নদীভাঙনে হাজার হাজার মানুষ প্রতিবছর গৃহহারা হন। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি দীর্ঘদিন থেকে ভারত ঝুলিয়ে রেখেছে। ফলে তিস্তা পাড়ের লাখ লাখ মানুষকে বাঁচাতে বর্তমান সরকার নতুন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে উত্তরের জেলা লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলার আর্থিক সমৃদ্ধি স্থায়ী রূপ নেবে। মানুষ কাজ পাবেন। পাল্টে যাবে এসব জেলার মানুষের জনজীবন। তিস্তা পাড়ের মানুষের দুঃখের দিন শেষ হয়ে যাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চীনের প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগে একটি চক্র এর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার শুরু করেছে। তাদের মতে, চীনের অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এমন আশঙ্কার কথা উড়িয়ে দিয়ে বলা হয়, এটি বাংলাদেশের একটি উন্নয়ন প্রকল্প। বিশ্বের সকল দেশকে এখানে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়া হয়। চীন এগিয়ে এসেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে চীন সরকারের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে যান। সেই সময় চীনের সঙ্গে উন্নয়ন প্রকল্প ও বাণিজ্য বিষয়ে বেশ কয়টি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও স্মারক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। সেই সময় শেখ হাসিনা এক সময় চীনের দুঃখ খ্যাত হোয়াংহো নদী নিয়ন্ত্রণ করে চীনের আশীর্বাদে পরিণত করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের তিস্তাকে আশীর্বাদে রূপ দেয়া যায় কি-না তার প্রস্তাব করেন। চীন সরকার নিজ উদ্যোগে ও নিজ খরচে দুই বছর ধরে তিস্তা নদীর ওপর সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষা শেষে একটি প্রকল্প নির্মাণের প্রস্তাব দেয়।

চীনের টাকায় তিস্তা প্রকল্প হচ্ছে কয়েক মাস আগে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ভারত বাগড়া দেয়। ভারতের গণমাধ্যম নানাভাবে প্রচার করে তিস্তা প্রকল্পে চীন বিনিয়োগ করলে বাংলাদেশ ভারতের হাতছাড়া হয়ে যাবে। দিল্লির সাউথ বøক এখন ঢাকাকে যা করতে বলছে তাই করছে। চীন তিস্তায় বিনিয়োগ করলে বাংলাদেশ হাতছাড়া হয়ে যাবে ভারতের। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ভারতের বাধা উপেক্ষা করেই তিস্তা প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান জানান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে তার দফতরকে জানানো হয়েছে বাংলাদেশ সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে পরিকল্পনা, ড্রইং, ডিজাইন করেছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয় সব কিছু বিশ্লেষণ করেছে। তারা চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। বর্তমান সরকারের আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। এ বিষয়ে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও রংপুর অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, তিস্তা বর্তমান সরকারের একটি বড় প্রকল্প। চীনের অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এ প্রকল্পের সব কিছু পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে করা হচ্ছে। আমার জানামতে, পরিকল্পনা কমিশন থেকে অর্থায়নের বিষয়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

ট্যাগ :

আরো সংবাদ

ফেইসবুকে আমরা



আর্কাইভ
November 2024
M T W T F S S
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  
আলোচিত খবর

error: কি ব্যাপার মামা !!