পুলিশ জনগণের বন্ধু প্রচলিত কথাটি বর্তমান সময়ে বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের প্রত্যেক সদস্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। পুলিশ বাহিনী প্রশংসনীয় উদ্যোগ, কর্মতৎপরতা, মহানুভবতা, কঠিন এই বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া, প্রতিটি নাগরিককে সুরক্ষা দিতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া বাঙালি জাতির জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত
জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে পুলিশ সপ্তাহের এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘মুজিববর্ষে অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার’। অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আসলে পুলিশকে জনতারই হতে হবে। জনগণ যেন আস্থা পায়, বিশ্বাস পায়, পুলিশের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। সেই কাজটি করতে হবে। বর্তমানে করোনাভাইরাসের সংকটকালে বাংলাদেশ পুলিশ এখন জনতার পুলিশের ভূমিকায় কাজ করে যাচ্ছে। মুজিব বর্ষেও অঙ্গীকারকে ব্রত হিসেবে নিয়ে পুলিশ বিভাগ যেভাবে কাজ করে যাচ্ছে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশের আছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করতে প্রথম জীবন দিয়ে ছিল পুলিশবাহিনীর সদস্যরা। বর্তমান সরকারের আমলেও পুলিশের অনেক অর্জন রয়েছে, বিএনপি-জামায়াতের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমকে প্রতিহত করতে গিয়ে অনেক পুলিশ ভাইদের জীবন দিতে হয়েছে, ৫ মে হেফাজতের তান্ডবকে প্রতিহত করে ঢাকা মহানগরীর শান্তি বজায় রাখতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে, হলিআর্টিজানে জঙ্গি হামলাকে পরাস্ত করতে একাধিক পুলিশ অফিসারকে জীবন দিতে হয়েছিল। বাংলাদেশের জঙ্গি দমনে পুলিশের ভূমিকা সারা বিশ্বে নন্দিত। তারপরও কিছু অপেশাদার পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকায় মাঝে মাঝে গৌরব প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তবে এবার করোনাযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা সারা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে।
ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশ এলাকায় পুলিশি ব্যবস্থা চালু করে, তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এ দেশীয় মানুষকে দমন করা। তাদের শাসন ব্যবস্থাকে মজবুত করা। দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসন, চব্বিশ বছরের পাকিস্তানি শাসন, স্বাধীন বাংলাদেশের জিয়া, এরশাদ, খালেদা মিলে যেভাবে পুলিশকে দলীয় লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ভিন্নমতকে প্রতিহত করতে অপব্যবহার করেছে। সেই ট্র্যাডিশন থেকে বের হতে একটু সময়তো লাগবেই। তবে আশার কথা বাংলাদেশ পুলিশ মানবিক পুলিশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
আপনি ঘরে থাকুন, সচেতন থাকুন। নিজে বাঁচুন, পরিবারকে বাঁচান। দেশকে বাঁচান। এই স্স্নোগান সামনে রেখে মাইক হাতে নিয়ে শহরের অলিগলি, গ্রামের পাড়া-মহলস্না, হাটবাজারসহ সমগ্র বাংলাদেশের মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ। নিজের জীবন বা পরিবারের কথা চিন্তা না করে দিনরাত রাস্তায় কাজ করে যাচ্ছে। জনসাধারণের শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, লাখো লাখো মানুষের হোমকোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, জীবাণুনাশক ওষুধ ছিটিয়ে রাস্তাঘাট জীবাণুমুক্ত করা, বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকারী জনগণকে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়া, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর পরিবারের লোকজন দূরে চলে গেছে, সে ক্ষেত্রেও পুলিশবাহিনীর সদস্যরা রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছে। করোনা আক্রান্ত কোনো রোগী মৃতু্যবরণ করলে অনেক ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ধর্মীয় বিধান মেনে লাশ দাফনের ব্যবস্থাও করতে হচ্ছে পুলিশকে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গর্বের সেনাবাহিনী মাঠ পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যরা মানুষের শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে গিয়ে তাদের সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে আসতে হচ্ছে; ফলে পুলিশ সদস্যদেরও সংক্রামণের ঝুঁকি বেড়েই যাচ্ছে। কারণ তারা জানে না কে আক্রান্ত, আর কে সুস্থ। ইতোমধ্যে অনেক পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হয়েছে, জীবনও দিয়েছে।
মানুষ কোনো রোগে আক্রান্ত হলে সেবা দেবে ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা এটাই চিরাচরিত প্রথা। করোনাভাইরাসের যেহেতু প্রতিষেধক তৈরি হয়নি, তাই প্রতিরোধই একমাত্র মুক্তি। প্রতিরোধ কার্যক্রম নিশ্চিত করার দায়িত্ব পড়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর। মাঠ পর্যায় পর্যন্ত পুলিশ কাজ করে বলে তাদেরই মুখ্যভূমিকা পালন করতে হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি পুলিশবাহিনীর কাছে এনে দিয়েছে ভিন্ন এক বাস্তবতা। সারা বাংলাদেশে লকডাউন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য দিনরাত কাজ করতে হচ্ছে। জনসাধারণকে ঘরে রাখার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও গান গেয়ে জনগণের মাঝে সচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছে। ঢাকা মহানগরে পুলিশ প্রতিদিন ছয় হাজার মানুষকে একবেলা করে খাবার দিচ্ছে, অন্যান্য মহানগর ও জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে অনুরূপকার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এই সংকটে পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়ে পায়নি এমন অভিযোগ এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি। জাতীয় জরুরিসেবা ৯৯৯ চালু হওয়ার পর মানুষের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। কোথাও কোনো অন্যায় দেখলে, কোনো সমস্যা তৈরি হলে ফোন করলেই মুহূর্তেই পুলিশ হাজির হয়ে যাচ্ছে, দ্রম্নত ব্যবস্থাও নিচ্ছে। ২৪ ঘণ্টাই জনগণ যে কোনো জরুরি সেবা গ্রহণ করতে পারছে।
পুলিশ জনগণের বন্ধু প্রচলিত কথাটি বর্তমান সময়ে বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের প্রত্যেক সদস্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। পুলিশ বাহিনী প্রশংসনীয় উদ্যোগ, কর্মতৎপরতা, মহানুভবতা, কঠিন এই বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া, প্রতিটি নাগরিককে সুরক্ষা দিতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া বাঙালি জাতির জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত।
বর্তমান আইজিপি ড. বেনজির আহমেদ বলেছেন, পুলিশকে সবসময় জনগণের পাশে থাকতে হবে। মানুষের সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করা যাবে না। কোনো শারীরিক নির্যাতন করা যাবে না। মানুষের সঙ্গে মানবিক আচরণ করতে হবে। একটি ঘটনার কথা উলেস্নখ করে লেখা শেষ করব, পঞ্চানন গায়েন নামে ৭২ বছরের একজন বৃদ্ধ সাতক্ষীরা গ্রামের বাড়ি যাওয়ার অপেক্ষায় ১৯ দিন যাবত গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে বসে থাকে অনাহারে অর্ধাহারে। এ খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে, এগিয়ে আসে একজন পুলিশ সদস্য। বৃদ্ধলোকটিকে গ্রামের বাড়ির পৌঁছানো, ওষুধ, খাবারের ব্যবস্থাও করে দেয়া হয়েছে। এটাই মানবিক পুলিশের উদাহরণ। করোনাভাইরাসের মহামারিতে সম্পূর্ণ এক নতুনরূপে আমাদের মাঝে হাজির হয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ। অসহায় মানুষের কাছে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে সবার আগে এগিয়ে আসছে পুলিশ সদস্যরা। বর্তমান সময়ে পুলিশের ভূমিকা জনগণের মাঝে আস্থার সংকট দূর করে, শ্রদ্ধা ও সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করবে।
তাপস হালদার: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা
যধষফবৎঃধঢ়ধং৮০@মসধরষ.পড়স