বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধীদের কোনো রকম ছাড় দেবে না সরকার। বিষয়টিকে নিছক কোনো ধর্মীয় বিষয় মনে করছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। তারা মনে করছে, এটি একটি রাজনৈতিক ‘এজেন্ডা’ এবং এর পেছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত রয়েছে। সরকার ও আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে জানা যায়, ক্ষমতাসীনরা মনে করছে ভাস্কর্যের ইস্যুটি একটি পরিকল্পিত ইস্যু। হঠাৎ করে এ ইস্যু সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। অথচ এতদিন এ বিষয়ে তারা সরব হয়নি। একই সময়ে বিএনপির পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্থাপনা থেকে জিয়াউর রহমানের নাম সরানোর বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা হয়েছে।
ক্ষমতাসীনরা বলছে, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত করে তোলার জন্য এর পেছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত থাকতে পারে। তাই ভাস্কর্যবিরোধী প্রচারণাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় দেখছে আওয়ামী লীগ।
তবে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে সতর্কতার সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে এগোতে চায়। তাই মধ্যপ্রাচ্য ও ইসলামী অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও তারা যোগাযোগ করছে। এ ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে তুরস্ক তার দেশে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করবে। আর বাংলাদেশ ঢাকায় স্থাপন করবে আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্কের একটি ভাস্কর্য। তুরস্ক বর্তমান সময়ে মুসলিম বিশে^র প্রতিনিধিত্বশীল একটি দেশ।
এসব বিষয় নিয়ে গত বুধবার সচিবালয়ের তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে কথা বলেন ঢাকায় নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মুস্তাফা ওসমান তুরান।
দলের নেতারা বলছেন, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য প্রশ্নে কোনো আঁতাত বা সমঝোতা সম্ভব নয়। এসব কর্মকাÐের সমুচিত জবাব দেওয়া হবে রাজনৈতিকভাবে। মুসলিম দেশ সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কের মতো জায়গায় ভাস্কর্যের ব্যবহার পুরনো হলেও বাংলাদেশে এর বিরোধিতায় নেমেছে হেফাজতে ইসলাম ও খেলাফতে মজলিসের মতো কিছু ধর্মীয় সংগঠন। মূর্তি ও ভাস্কর্যের পার্থক্যও মানতে নারাজ এমন দলগুলোর অনুসারীরা। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, মূর্তি ও ভাস্কর্যের অপব্যাখ্যায় জাতির পিতাকে পরিকল্পিতভাবে হেয় করা হচ্ছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার।
গত বুধবার এক প্রজ্ঞাপনে পূর্বানুমতি ছাড়া ঢাকা মহানগরীতে যে কোনো ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। কেউ এমন কার্যকলাপে জড়িত হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়। ঢাকা মহানগরীর নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যেকোনো সভা-সমাবেশ ও গণজমায়েত থেকে বিরত থাকার এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানানো হয়।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নিয়ে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অনভিপ্রেত ও উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এ দেশের আবহমানকালের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ বলে আমরা মনে করি। তারা ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মপ্রিয় মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ জুনায়েদ বাবুনগরীর ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ছুড়ে ফেলা হবে’ এমন বক্তব্যকে ‘উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ ছড়ানোর অপচেষ্টা’ হিসেবে বিবৃত করেছেন।
সময়ের আলোকে তিনি জানানÑ সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও পাকিস্তানসহ বিশে^র অনেক মুসলিম দেশেই ভাস্কর্য রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশে ভাস্কর্য হতে পারবে না কেন? এ ধরনের উগ্রবাদী ও জঙ্গিবাদী কথাবার্তা বলে তারা ইসলামের মতো শান্তির ধর্মকে মানুষের কাছে বিতর্কিত করে তুলছে এবং মূর্খের মতো উন্মাদনা ছড়ানোর চেষ্টা করছে। সরকার বা জনগণ কেউই এটি বরদাশত করবে না।
ঢাকার দোলাইপাড় চত্বরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে অক্টোবরের শুরু থেকেই ইসলামপন্থি কয়েকটি দল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে এলেও বিষয়টি আলোচনায় আসে ১৩ নভেম্বর ঢাকায় একটি সম্মেলনে খেলাফত মজলিশের শীর্ষ নেতার বক্তব্যের পর।
সে সময় তিনি সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, ভাস্কর্য নির্মাণ পরিকল্পনা থেকে সরে না দাঁড়ালে তিনি আরেকটি শাপলা চত্বরের ঘটনা ঘটাবেন এবং ওই ভাস্কর্য ছুড়ে ফেলবেন। তার ওই বক্তব্য সরকারি দল আওয়ামী লীগে অস্বস্তি তৈরি করে। এরপর আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও দলটির সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, তারা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন।
এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শুরু করে মামুনুল হকের বিরুদ্ধে। ঢাকায় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয়ভাবেও সমাবেশ করে ভাস্কর্যের বিরোধিতাকারীদের উচিত জবাব দেওয়ার হুমকি দেয়। পরে আওয়ামী লীগ বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মাঝে পর্যালোচনা শেষে বিষয়টিকে হালকাভাবে না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ দাবিতে হেফাজত মাঠে নামতে চাইলে তাদের কঠোরভাবে দমনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অতীতের মতোই ধর্ম ব্যবসায়ীদের মোকাবিলা করা হবে জানিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ধর্ম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কোনো আপস নেই। কোনো সমঝোতারও প্রয়োজন নেই। অতীতে যেভাবে মোকাবিলা করা হয়েছে, ভবিষ্যতে একইভাবে করা হবে।
ধর্ম ব্যবসায়ীদের কঠোরভাবে দমন করা হবে জানিয়ে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সময়ের আলোকে জানান, ধর্মকে ব্যবহার করে যারা দেশকে নিশ্চিত অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে চায়, এসব ধর্ম ব্যবসায়ীকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
তিনি বলেন, জাতির পিতার এসব ভাস্কর্য দেখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে জানবে। নতুন প্রজন্ম যখন এসব ভাস্কর্য দেখবে, তখন সে বঙ্গবন্ধুকে জানবে। কীভাবে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে না জানলে বাংলাদেশকে জানা যাবে না। এ ধর্ম ব্যবসায়ীরা আমাদের বাংলাদেশ সৃষ্টি সম্পর্কে জানতে দিতে চায় না।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে এখনও কর্মসূচি না দিলেও কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগসহ সমমনা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন। মানববন্ধন, প্রতিবাদ কর্মসূচি ও বিক্ষোভ মিছিলের মতো কর্মসূচি থেকে তারা ভাস্কর্যের বিরোধিতাকারীদের কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করে দেন। প্রয়োজনে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে বলেও জানান তারা।
জানতে চাইলে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ বলেন, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির কোথা থেকে টাকা আসছে, তাদের এজেন্ডা কী, এসব বিষয়ে প্রশাসনিক তদন্ত হওয়া উচিত। প্রশাসনিক তদন্তের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারী ও তাদের মদদদাতাদের চিহ্নিত করতে হবে। এই দেশের মাটিতেই তাদের শাস্তি দিতে হবে। তাদের একেবারে নির্মূল করে দিতে হবে। তারা যেন বারবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে।
স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু বলেন, জাতির পিতার ভাস্কর্য সভ্যতার ধারা বিবরণী। একাত্তরের পরাজিত অপশক্তি, ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্টের খুনিচক্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বিএনপি-জামায়াতের মদদপুষ্ট ধর্ম ব্যবসায়ী ফতোয়াবাজদের রুখে দিতে প্রস্তুত স্বেচ্ছাসেবক লীগ। ধর্মের অপব্যাখ্যাকারীদেরও প্রতিহত করা হবে।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, যারা সাম্প্রদায়িকতার বীজ এই দেশে ছড়িয়ে দিতে চায়, তারা দেশদ্রোহী বলে বিবেচিত হবে। ভুলে গেলে চলবে না, এ দেশে দেশদ্রোহীদের ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয়েছে। ভাস্কর্যবিরোধীদের বিরুদ্ধে সারা দেশের ছাত্রদের নিয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারিও দেন তিনি।
ডিসেম্বরেই দোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন : ভাস্কর্য পরিষদ : জাতির জনকের ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতার কারণ রাজনৈতিক। তাই এই মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই নগরীর দোলাইপাড়ের নির্দিষ্ট স্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপন করতে হবে। এই দাবি করেছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বাস্তবায়ন পরিষদ। একই সঙ্গে দেশের প্রতিটি জেলায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের দাবিও জানিয়েছে তারা।
সংগঠনটি বলেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর যে ভাস্কর্য স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে সেটা যথাসময়ে যথাস্থানে হবেই হবে। ধর্ম ব্যবসায়ীরা মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য এর বিরোধিতা করছে। বৃহস্পতিবার নগরীর সেগুনবাগিচায় অবস্থিত ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বাস্তবায়ন পরিষদের আহŸায়ক ড. মো. আওলাদ হোসেন বলেন, এই বিজয়ের মাসেই স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য যাতে যথাস্থানে স্থাপিত হয় সেই দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি সোনার বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনেরও দাবি জানাচ্ছি। যেসব ষড়যন্ত্রকারী বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করছে মূলত তারা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরোধিতা করছে। তাদের অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, যারা ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করছে তারাই বিএনপি-জামায়াত জোটের সময় ২০-দলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত সংগঠনের নেতৃত্বে থেকে জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্য উদ্বোধন করেছে। বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের অসংখ্য ভাস্কর্য আছে। এখন মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
সংবাদ সম্মেলনে ১৮৯ সদস্যবিশিষ্ট বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বাস্তবায়ন পরিষদের কমিটি ঘোষণা করা হয়। অনুষ্ঠানে পরিষদের যুগ্ম আহŸায়ক ও কদমতলী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ নাছিম মিয়া, যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন আর রশিদ ও শ্যামপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বাবুসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।