প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে আরও একটি পথ সুগম হলো। করোনার টিকা সরবরাহের বৈশ্বিক জোট কোভ্যাক্সের মাধ্যমে চাহিদা অনুযায়ী টিকা পাবে বাংলাদেশ। গত রোববার সংস্থাটির পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশের কী পরিমাণ টিকা লাগবে, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। আগামী শনিবারের মধ্যে টিকার চাহিদার তথ্য কোভ্যাক্সকে জানাতে বলা হয়েছে। ওই চিঠি পাওয়ার পর কাজ শুরু করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। কোভ্যাক্স থেকে কোন প্রক্রিয়ায় টিকা পাওয়া যাবে এবং কতদিনের মধ্যে টিকা আসবে, তা নিয়ে পর্যালোচনা চলছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস-গ্যাভির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বৈশ্বিক উদ্যোগ কভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটি (কোভ্যাক্স)। কোভ্যাক্স থেকে আগে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশকে টিকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এ হিসাবে বাংলাদেশের ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ পাওয়ার কথা। এর মধ্যে আগামী মে মাসের মধ্যে এক কোটি ৯ লাখ ডোজ পাওয়ার কথা ছিল; কিন্তু এখনও কোনো টিকা পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় কোভ্যাক্স থেকে আবারও চিঠি দিয়ে টিকার চাহিদার কথা জানতে চাওয়া হলো। কোভ্যাক্সের টিকা দেওয়ার আগ্রহের বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ভারতের সেরাম কিংবা কোভ্যাক্সের ওপর নির্ভরশীল না থেকে বিকল্প উৎস থেকেও টিকা পেতে তৎপরতা শুরু করেছে সরকার। এ লক্ষ্যে তিন দেশের পাঁচটি টিকার বিষয়ে পর্যালোচনা চলছে। এগুলোর মধ্য থেকে যে কোনো একটি অথবা দুটি টিকাকে বিকল্প উৎস হিসেবে হাতে রাখতে চাইছে সরকার।\হএ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সমকালকে বলেন, কোভ্যাক্স আগে বলেছিল, দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ টিকা আমাদের দেবে। প্রথমে বলা হয়েছিল, ওই টিকার দাম পড়বে দুই ডলারের নিচে। পরে জানানো হয়, ওই ২০ শতাংশ টিকা বিনামূল্যে পাওয়া যাবে। কিন্তু ২০ শতাংশের বাইরে কোনো টিকার প্রয়োজন হলে এবং তা কোভ্যাক্স থেকে নেওয়া হলে সেগুলোর প্রতি ডোজের দাম পড়বে সাত ডলার করে।
মহাপরিচালক আরও বলেন, কোভ্যাক্স থেকে চিঠি পাওয়ার পর মন্ত্রণালয়সহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। বিষয়টি পর্যালোচনা করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাদের কী পরিমাণ টিকা লাগবে, তা নিরূপণ করে তিনি কোভ্যাক্সের চিঠি জবাব দেবেন।
কোভ্যাক্স কোন টিকা সরবরাহ করবে- এমন প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, কোভ্যাক্সের কাছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পাওয়া সব ক'টি টিকা রয়েছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসন, ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্নাসহ যে ক'টি টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেয়েছে সেগুলো কোভ্যাক্সের কাছে পাওয়া যাবে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন নেই- এমন টিকা কোভ্যাক্স সরবরাহ করবে না।
স্বাস্থ্য বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, কোভ্যাক্সের ওপর ভরসা করে টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রাখা দুস্কর হতে পারে। কারণ কোভ্যাক্স কীভাবে টিকা দেবে, সে সম্পর্কে এখনও বিস্তারিত কিছু জানায়নি। আগামী মে মাসের মধ্যে কোভ্যাক্স থেকে এক কোটি ৯ লাখ ডোজ টিকা পাওয়ার কথা ছিল। চলতি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে ওই টিকা আসার কথা ছিল; কিন্তু টিকা পাওয়া যায়নি। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কোভ্যাক্সে টিকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারত সরকার রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় সেরাম কোভ্যাক্সে টিকা দিতে পারেনি। এ কারণে বাংলাদেশসহ অন্য যেসব দেশ কোভ্যাক্স থেকে টিকা পাওয়ার কথা ছিল, তা কেউ পায়নি।
অন্য এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, কোভ্যাক্স নিজে টিকা উৎপাদন করে না। অন্যান্য দেশের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে টিকা নিয়ে তারা চাহিদার ভিত্তিতে জোটের সদস্য ১৯৮টি দেশে বণ্টন করবে। এক্ষেত্রে একসঙ্গে পাঁচ কোটি ডোজ টিকা দিলে তা বিতরণের সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। কারণ টিকার মেয়াদের বিষয় আছে। নির্দিষ্ট মেয়াদে ওই পরিমাণ টিকা বিতরণ করা সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে টিকার মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। যেমন সেরাম থেকে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়ার কথা ছিল। এ পরিমাণ টিকা বিতরণের সক্ষমতা স্বাস্থ্য বিভাগের রয়েছে। আবার যখন প্রয়োজন পড়বে তখন কোভ্যাক্স থেকে টিকা পাওয়া নাও যেতে পারে। কোভ্যাক্সের টিকা নেওয়ার আগে এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।\হকোভ্যাক্সের টিকার সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সমকালকে বলেন, দেশে মোট সাড়ে ১৩ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ভারতের সেরাম থেকে তিন কোটি ডোজ কেনার চুক্তি হয়েছে। এই টিকা দেড় কোটি মানুষকে দেওয়া সম্ভব হবে। কোভ্যাক্স থেকে মোট জনগোষ্ঠীর ২০ শতাংশ অর্থাৎ ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা পাওয়া যাবে। এ দিয়ে আরও তিন কোটি ৪০ লাখ মানুষ টিকার আওতায় আসবে। মোট চার কোটি ৮০ লাখ মানুষের টিকা নিশ্চিত হলো। এ ছাড়া অন্যান্য উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। তিনি আরও বলেন, সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে কোভ্যাক্সের চিঠির জবাব দেওয়া হবে। কারণ, টিকার প্রয়োজন রয়েছে।\হবিকল্প উৎস থেকেও টিকা কেনার প্রস্তুতি :করোনাভাইরাসের টিকার তিন কোটি ডোজের জন্য ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি রয়েছে। এর আওতায় ৭০ লাখ ডোজ টিকা এসেছে। চুক্তির বাকি টিকাও পর্যায়ক্রমে চলে আসবে। কিন্তু ভারতে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির পর সে দেশের সরকার টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এরপর মার্চ থেকে চুক্তি অনুযায়ী টিকা পায়নি বাংলাদেশ। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসেও ৩০ লাখ ডোজ টিকা কম এসেছে। এপ্রিলের টিকা এখনও আসেনি। তবে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, এপ্রিলের শেষ দিকে সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ৫০ লাখ ডোজ টিকা আসবে। সেরামের টিকার অনিশ্চয়তা সৃষ্টির পর বিকল্প উৎস থেকে টিকা পেতে তৎপরতা চালাচ্ছে বাংলাদেশ। তিন দেশের পাঁচটি টিকাকে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখে সেগুলোর মধ্যে যে কোনো একটি পেতে চেষ্টা করছে সরকার। এ লক্ষ্যে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি এরই মধ্যে গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটিকে আগামী সাত দিনের মধ্যে বিকল্প টিকার সুপারিশ করে প্রস্তাবনা পাঠাতে বলা হয়েছে। গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে এক সভায় বিকল্প টিকার বিষয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই পাঁচটি টিকার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জনসন অ্যান্ড জনসন ও মডার্না, চীনের সিনোফার্ম ও ক্যানসিনো এবং রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি রয়েছে। এই পাঁচটি টিকা পর্যালোচনা করে গুণগত মানসম্পন্ন ও দ্রুততম সময়ে পাওয়া যাবে- এমন টিকার সুপারিশ করতে বলা হয়েছে কমিটিকে। যুক্তরাষ্ট্রের জনসন অ্যান্ড জনসন ও মডার্নার টিকার প্রস্তাবক বাংলাদেশের ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানি রেনাটা ফার্মাসিউটিক্যালস। ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের টিকা বাংলাদেশে সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করবে রেনাটা। চীনের সিনোফার্ম ও ক্যানসিনো টিকা দুটির প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন। চীনের টিকা উৎপাদনকারী ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে সরবরাহকারী হিসেবে বাংলাদেশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন কাজ করবে। স্পুটনিক-ভি টিকার বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ চলছে। এই পাঁচটি টিকার মধ্যে কোনটি অধিকতর কার্যকর এবং দ্রুততম সময়ে পাওয়া যাবে, তা যাচাই-বাছাই করতে কমিটিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করে আরও তিন কোটি ডোজ টিকা কেনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য সব প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি ইউএনডিপির অর্থায়নে জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার তিন কোটি ডোজ কিনতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই টিকা আগামী সেপ্টেম্বরের আগে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, শুরুতে একটিমাত্র উৎস ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে তিন কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি হয়। কারণ, ফাইজার ও মডার্নার টিকার সংরক্ষণ সুবিধা বাংলাদেশে নেই। এ কারণে ওই দুটি টিকার জন্য চেষ্টা করা হয়নি। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাটি আমাদের জন্য উপযুক্ত ছিল। এ কারণে ওই টিকার উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। এরপর কোভ্যাক্স থেকেও ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা আসার কথা রয়েছে। এর মধ্যে আগামী মে মাসের মধ্যে এক কোটি ৯ লাখ ডোজ টিকা পাওয়ার কথা ছিল। সেরাম ইনস্টিটিউট কোভ্যাক্সে টিকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারত সরকারের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে কোভ্যাক্স টিকা পায়নি। এ কারণে বাংলাদেশেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টিকা দিতে পারেনি কোভ্যাক্স। আবার বাংলাদেশও চুক্তি অনুযায়ী সেরাম থেকে টিকা পায়নি। এ অবস্থায় একটি মাত্র উৎসের ওপর নির্ভরশীল না থেকে বিকল্প একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে থেকে যে কোনো একটি অথবা দুটি উৎস থেকে টিকা পাওয়া যাবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
Publisher - Lutfur Rahman (Uzzal)
Published By The Editor From chttimes (Pvt.) Limited (Reg.No:-chttimes-83/2016)
Main Road,Gurosthan Mosque Market, Infront of district food Storage, Bandarban hill district,Bandarban.
Phone - News - 01673718271 Ad - 01876045846
Copyright © 2024 Chttimes.com. All rights reserved.