বিনামূল্যে টিকা পাবে দেশের সব মানুষ


অনলাইন ডেস্ক প্রকাশের সময় :৪ জানুয়ারি, ২০২১ ৬:১২ : অপরাহ্ণ 337 Views

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা ব্যবহারের তালিকায় প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে একের পর এক দেশের নাম। অধীর অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশের মানুষও। এরই মধ্যে প্রস্তুতি চলছে দেশের সব মানুষকে টিকাদান কার্যক্রমের আওতায় আনার। শুধু তাই নয়, দেশের পুরো জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে টিকা নিশ্চিত করতে কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন। একই সঙ্গে বাড়তি টিকা আমদানির জন্য সংশ্নিষ্ট বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে সরকারিভাবে সবার টিকা পাওয়া নিয়ে যে সংশয় ছিল, তা দূর হতে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্নিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা দ্রুততম সময়ে টিকা নিশ্চিত করার কাজ শুরু করেছেন। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার পাশাপাশি সম্ভাব্য আরও কয়েকটি টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট শুরুতে বাংলাদেশকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার তিন কোটি ডোজের বেশি দিতে রাজি ছিল না। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার পর তারা এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। একই সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গেও সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে যোগাযোগ হচ্ছে।

স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র বলছে, চীনের চংকিং জিফেই বায়োলজিক্যাল প্রডাক্টস লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আনুই জিফেই লংকম বায়োফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি লিমিটেড বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের (ট্রায়াল) প্রস্তাব দিয়েছে। টিকার ট্রায়ালের সব খরচ বহন করবে প্রতিষ্ঠানটি। ট্রায়াল সফল হলে বাংলাদেশে টিকার গবেষণার পাশাপাশি টিকা উৎপাদনের কারখানা স্থাপনের উদ্যোগও নেবে প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে চীনের আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাক বাংলাদেশে টিকার ট্রায়ালের প্রস্তাব দিয়েছিল। বাংলাদেশ ওই টিকা ট্রায়ালে প্রস্তুতিও নিয়েছিল। কিন্তু শেষ সময়ে ট্রায়ালের জন্য বাংলাদেশের কাছে অর্থ দাবি করা হয়। সরকার ওই অর্থায়নে রাজি না হওয়ায় দেশে সিনোভ্যাকের টিকার ট্রায়াল আর হয়নি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, চীনের রাষ্ট্রদূতের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে টিকা ট্রায়ালের প্রস্তাব দেয়। সফল হলে টিকার গবেষণা ও কারখানা স্থাপন করে বাংলাদেশে টিকা উৎপাদনের আগ্রহ প্রকাশ করেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সমকালকে বলেন, চীনের রাষ্ট্রদূতকে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবনা দিতে বলেছি। তারা প্রস্তাবনা দিলে তা যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

পর্যায়ক্রমে টিকা পাবেন সবাই :যুক্তরাজ্য ও ভারতে অনুমোদনের পর চলতি মাসেই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা বাংলাদেশে আসছে বলে সংশ্নিষ্টরা আশাবাদী। ওই টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে এ সপ্তাহেই ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছে অগ্রিম টাকা পাঠানো হচ্ছে। এরই মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় ওই টিকার জন্য ৬০০ কোটি টাকা ছাড় করেছে। প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে টিকা আসবে। সে হিসাবে আগামী জুন মাস পর্যন্ত তিন কোটি ডোজ টিকা পাবে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র বলছে, ওই টিকা শেষ হওয়ার আগেই কোভ্যাক্সের আওতায় আরও ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা আসবে। দেশের চার কোটি ৯০ লাখ মানুষ এই টিকার আওতায় আসবে। এই টিকা দিতে সময় লাগবে প্রায় এক বছর। এরপরও দেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ টিকার বাইরে থাকবে। বাদপড়া জনগোষ্ঠীর তালিকা তৈরি হচ্ছে।

সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সবাইকে টিকা দেওয়া যাবে না। বিশেষ করে ১৮ বছরের কম বয়সী জনগোষ্ঠী এই টিকা পাবে না। কারণ এই বয়সীদের ওপর টিকার ট্রায়াল হয়নি। বাংলাদেশে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০ ভাগের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এ ছাড়া প্রসূতি নারীরা টিকার আওতায় আসবেন না। একই সঙ্গে বিদেশে অবস্থানকারী প্রায় এক কোটি মানুষের টিকার প্রয়োজন হবে না। এ হিসাবে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি মানুষের জন্য টিকার দরকার হবে না। এর বাইরে ১০ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ প্রথম বছরেই টিকার আওতায় চলে আসবে। বাকি থাকবে আরও যে পাঁচ কোটি মানুষ- তাদের টিকার আওতায় আনতেই প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের পুরো জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনার বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন। এর জন্য তিনি বাড়তি টিকা আনারও নির্দেশনা দিয়েছেন। এর পরপরই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার পাশাপাশি সম্ভাব্য টিকা উৎপাদনকারী দেশ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছি। প্রথমে সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছে তিন কোটি ডোজের বেশি টিকা চেয়েছিলাম; কিন্তু তারা রাজি হয়নি। এখন আবার তাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তারা আরও কিছু টিকা দেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। আশা করি সেরাম থেকে আরও টিকা আসবে। এর বাইরে চীনসহ আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তারাও ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। সুতরাং টিকা নিয়ে কোনো সংকট হবে না।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, শুরুতে যে ৯ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা আসবে তা দিতেই এক বছর সময় লেগে যাবে। এরপর পরিস্থিতি কী হয়, আদৌ টিকার প্রয়োজন হবে কিনা, সে সম্পর্কে এখনও কেউ নিশ্চিত নন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ টিকা নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশেও এ ধরনের অনাগ্রহী ব্যক্তি থাকতে পারে। কিন্তু তাদের সংখ্যা কত, তা এখনও জানা যায়নি। তবে যারা নিতে চাইবে সরকার তাদের জন্য পর্যায়ক্রমে টিকার ব্যবস্থা করবে।

টিকার অগ্রিম টাকা যাচ্ছে চলতি সপ্তাহেই :ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কেনার জন্য ৬০০ কোটি টাকার বেশি অগ্রিম হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম সমকালকে বলেন, ওই টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়া হবে। বিনিময়ে সেরাম ইনস্টিটিউট ব্যাংক গ্যারান্টি দেবে। প্রথম চালানের টিকা বাংলাদেশে আসার পর সেরাম ইনস্টিটিউট ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে পারবে। টিকা সরবরাহ শুরু হলে বাকি টাকা দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে শতভাগ গ্যারান্টি থাকবে। কোনো কারণে সেরাম ইনস্টিটিউট টিকা দিতে ব্যর্থ হলে পুরো টাকাই সরকার ফেরত নিয়ে আসতে পারবে।

উল্লেখ্য, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার তিন কোটি ডোজ কিনতে গত ৫ নভেম্বর ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। ভারত থেকে টিকা এনে বাংলাদেশে সরবরাহের জন্য সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে টিকার ৫০ লাখ ডোজ পাবে বাংলাদেশ। প্রতি ডোজ টিকার দাম পড়বে চার ডলার। ভ্যাট, ট্যাক্স ও টিকার বণ্টনসহ ব্যয় পড়বে পাঁচ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এই টিকার দাম হবে ৪২৫ টাকা।

টিকাদানের প্রস্তুতি :টিকা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি গাইডলাইন তৈরি করেছে। প্রথমে করোনা চিকিৎসায় সরাসরি যুক্ত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকা পাবেন। পরে ধাপে ধাপে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী টিকার আওতায় আসবে। টিকা বণ্টনের জন্য সারাদেশে তিন স্তরে কমিটি গঠন করা হয়েছে। টিকা পেতে অনলাইনে ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। প্রতিষ্ঠানে টিকা বিতরণের জন্য ১৫ ধরনের প্রায় ছয় হাজার ৩০০টি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ১০ ও ২০ শয্যার হাসপাতাল, মা ও শিশু হাসপাতাল, পুলিশ হাসপাতাল, জাতীয় সংসদ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সচিবালয় ক্লিনিক ও সিটি করপোরেশন হাসপাতাল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও লাইন ডিরেক্টর ডা. হাবিবুর রহমান জানান, টিকা প্রদানের প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি দ্রুতই শেষ হবে।

ট্যাগ :

আরো সংবাদ

ফেইসবুকে আমরা



আর্কাইভ
December 2024
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
আলোচিত খবর

error: কি ব্যাপার মামা !!